দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের শহিদ বুদ্ধিজীবী হোস্টেলকে ঘিরে লাখ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, নায়েমের প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও শহিদ বুদ্ধিজীবী হোস্টেলের সুপার প্রফেসর মো. সাইদুর রহমান কোতোয়াল সহকারী হোস্টেল সুপার ও হোস্টেল অ্যাটেনডেন্টকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে লাখ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম করছেন।
দেশের ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু, কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম যেন সেই লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সে জন্য তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা।
এদিকে নায়েমের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মো. জুলফিকার হায়দার স্বাক্ষরিত গত রোববারের এক আদেশে হোস্টেলের আর্থিক অনিয়মসহ অন্যান্য অভিযোগ তদন্ত করার জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। নায়েমের পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা) প্রফেসর ফেরদৌসী বেগমকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্যের মধ্যে সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোজাম্মেল হককে সদস্যসচিব ও সহকারী পরিচালক মো. ফয়জুল আমিনকে (অর্থ) সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মহাপরিচালকের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রফেসর সাইদুর রহমান বেসরকারি কলেজ থেকে আত্তীকৃত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেন। সরকারের ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ)’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নায়েম ইউনিটে যোগদান করেন। গত বছর এই কর্মকর্তাকে প্রতিষ্ঠানটির শহিদ বুদ্ধিজীবী হোস্টেলের সুপার পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সাধারণত একটি কমিটির মাধ্যমে হোস্টেলের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। নায়েমের মহাপরিচালকের অনুমোদন নিয়ে কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে হোস্টেল সুপার হোস্টেল পরিচালনা করেন। কমিটিতে নায়েমের পরিচালক (প্রশাসন) আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। হোস্টেল সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পাশাপাশি মহাপরিচালকের অনুমোদন নিয়ে সেসিপের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের দায়িত্বও পালন করেছেন প্রফেসর সাইদুর রহমান।
সূত্রের দাবি, হোস্টেল সুপার পদে ওই কর্মকর্তার দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে তখনো নায়েমের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভিন্নমত ছিল। তবে নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তাহমিনা বেগম ভিন্নমত উপেক্ষা করেই ওই কর্মকর্তাকে হোস্টেল সুপারের দায়িত্ব দেন।
হোস্টেল ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও তদন্তের বিষয়ে নায়েমের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. জুলফিকার হায়দার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বেশ কিছু অসংগতি চোখে পড়েছে। তাই বিষয়টি সঠিকভাবে জানার উদ্দেশ্যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। নিয়মনীতি অনুযায়ী পরিচালনার জন্য বিষয়গুলোকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে সবকিছু করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মহাপরিচালক আরও বলেন, মাত্র অল্প কিছুদিন হয় আমি এখানে এসেছি। সবকিছু বুঝে নিতে একটু সময় লাগছে। তবে আমার দায়িত্ব পালনকালীন অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
অনিয়ম-দুর্নীতির যত অভিযোগÑ ১. হোস্টেলে আগত অতিথিদের ভাড়ার টাকা উত্তোলন করে এক সপ্তাহ অন্তর ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য নায়েম প্রশাসনের লিখিত নির্দেশনা রয়েছে। ব্যাংকে টাকা জমার পর নায়েমের পরিচালকের (প্রশাসন) কাছে এ বিষয়ে মাসিক প্রতিবেদন দাখিল করার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। এর ফলে বিগত ছয় মাসে প্রায় ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকা অনিয়ম করে লুটপাট হয়েছে।
সূত্রের দাবি, হোস্টেলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের আর্থিক লেনদেনের বিবরণী বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। পাশাপাশি হোস্টেলের রেজিস্ট্রার (অতিথিদের আসা-যাওয়ার নিবন্ধন) পরীক্ষা করলেও বিষয়টি জানা যাবে।
২. প্রধানত দুটি ফান্ড থেকে হোস্টেলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়। একটি হলো হোস্টেলে থাকার জন্য আগত অতিথিদের ভাড়া বাবদ আয়। আরেকটি হলো এসইডিপি প্রকল্পের স্কিম চালু হওয়ার পর প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে ভাড়া বাবদ সরকার থেকে পাওয়া টাকা। প্রফেসর সাইদুর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার সময় হোস্টেলের ফান্ডে কোটি টাকা ছিল, এরপর স্কিমের টাকা যোগ হওয়ায় আয়ও বেড়েছে।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে হোস্টেলের আয় বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকার বেশি। হোস্টেলে সিটেট সংখ্যা ৩০৪। প্রতি সিটের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ভাড়া ৩০০ টাকা, আগত অতিথিদের জন্য ভাড়া ৩৫০ টাকা। নায়েম হোস্টেলের সরকারি ফান্ডের টাকার অডিট হলেও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত টাকার ফান্ডের অডিট হয় না। অভ্যন্তরীণভাবে অডিট হলেও তা অনিয়মিত। বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত টাকার শেষ অডিট হয়েছে ২০২২ সালে সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. নিজামুল করিমের সময়। অডিট না হওয়ায় আর্থিক অনিয়মের সুযোগ অবারিত হয়েছে। সঠিকভাবে তদন্ত করলে আর্থিক অনিয়মের চিত্র স্পষ্ট হবে বলে সূত্রের দাবি।
৩. হোস্টেল ম্যানেজেমেন্ট কমিটি মিটিং করে রেজল্যুশনের মাধ্যমে মহাপরিচালক কর্তৃক নথি অনুমোদনের পর বিভিন্ন কোর্সের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এই খাতেও লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
৪. হোস্টেল সুপার কোর্স পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময়ে হোস্টেল ফান্ড থেকে অন্তত ১০ লাখ টাকা অগ্রিম নেন। তবে এজি অফিস থেকে প্রশিক্ষণ বাবদ সেই অগ্রিম টাকার চেক পাওয়া গেলেও তা জমা না করার অভিযোগ রয়েছে।
৫. হোস্টেলের পানির ফিল্টারের কিট নিয়মমতো পরিবর্তন না করে বাইরে থেকে টেকনিশিয়ান এনে মেশিন অটো করে সব সময় নীল বাতি জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এতে কিট পরিবর্তনের জন্য টাকা না লাগলেও এই খাতে কিট কনার নামে হোস্টেল ফান্ড থেকে টাকা উত্তোলন করা হতো। পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই প্রশিক্ষণার্থীদের পেটের পীড়ায় ভোগার কথা জানা গেছে।
৬. হোস্টেলের অবকাঠামো মেরামত ও সংস্কারের নামেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নায়েম স্কিম পরিচালনা ও নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত খাতসমূহে খরচ না করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের মধ্যে ভাগ করার নেওয়ার একটি রেওয়াজ চালু করেছেন বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা।
সূত্রের দাবি, হোস্টেল সুপার শরীয়তপুরের এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান। এই পরিচয় ব্যবহার করে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি নায়েমে প্রায় ১০ বছর ধরে চাকরি করা ও নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন।
প্রধান অভিযুক্তের মন্তব্য : এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির উল্লেখিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে প্রধান অভিযুক্ত হোস্টেল সুপার প্রফেসর সাইদুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আন্তরিকভাবে দায়িত্ব নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছি। এক্ষেত্রে হোস্টেলের ফান্ডের টাকা অগ্রিম নিয়ে কাজ করে পরে তা সমন্বয় করেছি। এভাবে কাজ করতে গিয়ে হয়তো সিস্টেমে ভুল হয়েছে। আমার অবশ্যই আরও সচেতন হয়ে কাজ করা উচিত ছিল।
নিয়ম মাফিক ব্যাংকে টাকা জমা না করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সব সময়ই নিয়ম মতো হয়। তবে জুলাই আন্দোলনের সময় ও হোস্টেল ফান্ড থেকে নেওয়া টাকার বিপরীতে বিল সময়মতো না আসায় তিন-চার মাস জমা বাকি রয়েছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ইতিমধ্যে ১০টির ওপরে প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত হয়েছে। অথচ এর বিপরীতে বিলগুলো এখনো পাওয়া হয়নি। এভাবে জট লেগে যায়। জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে পিপিআর লঙ্ঘন করা হয়নি বলে তিনি জানান। সমন্বয়ের ১০ লাখ টাকার বিপরীতে এজি অফিসের চেক জমা না করার অভিযোগ সঠিক নয়। সরকারি এই চেক সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায় বলে তিনি জানান।
পানির ফিল্টার পরিবর্তন না করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, পানির ফিল্টারে প্রায়ই ঝামেলা হয়। তাই কারিগরি অধিদপ্তরের একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে পানির ফিল্টার পরীক্ষা করে তার পরামর্শ অনুযায়ী চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ফিল্টারের কিট পরিবর্তন না করে ভাউচার দিয়ে টাকা ওঠানোর অভিযোগ সঠিক নয়। নায়েম হোস্টেলে নিয়মিত থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের ভাড়া না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গত জুন থেকে এই টাকা বকেয়া রয়েছে। ভাড়া আদায়ের জন্য তাদের লিখিত চিঠি দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। তবে জুলাইতে কিছু আদায় হওয়ায় চিঠি দেওয়া হয়নি। মৌখিকভাবে তাদের সব সময় তাগাদা দিয়েছি। এ ছাড়া শরীয়তপুরের এক আওয়ামী নেতার সন্তান হিসেবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার বিষয়টিও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।
হোস্টেল পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক নায়েমের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) প্রফেসর ড. শাহ মো. আমির আলী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, হোস্টেল সুপার ও সহকারী সুপারই মূলত পরিচালনার কাজটি দেখাশোনা করেন। আমরা শুধু হোস্টেল সুপার নিয়োগসহ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ করি। তার পরও যদি কোনো ব্যত্যয় হয়, ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, তদন্ত প্রতিবেদন ডিজির কাছে যাবে, উনি ব্যবস্থা নেবেন।
অন্যদিকে তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব নায়েমের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোজাম্মেল হক বলেন, কমিটি গঠনের চিঠি পেয়েছি। আজ (গতকাল) দুপুরে কমিটি আহ্বায়ক সভা ডেকেছে। সেখানে বিস্তারিত জানব। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট থাকব।