ঢাকা বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫

যাত্রীর হেলমেটে উদাসীন বাইকাররা

মোহাম্মদ সোহেল রানা
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
হালকা ও নিম্নমানের হেলমেট পরিয়ে যাত্রীকে নিয়ে যাচ্ছেন এক বাইকার। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজধানীতে মোটর রাইড শেয়ারিং পেশা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আইনি জটিলতা এড়াতে হেলমেট ব্যবহারেও তারা বেশ তৎপর। অথচ সে হেলমেট একেবারেই হালকা ও নিম্নমানের। বিশেষ করে যাত্রীর হেলমেট নামমাত্র। এতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

তবে এ নিয়ে ভারী হেলমেটে যাত্রীদের অনীহাসহ নানা অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন রাইডাররা। যদিও যাত্রীদের অভিযোগ, নিয়ম রক্ষার খাতিরেই সস্তার মানহীন হেলমেট বেছে নিচ্ছেন রাইডাররা। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও ঝুঁকি কমাতে ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করার বিকল্প নেই।

সাম্প্রতিককালে রাজধানীতে দিন দিন ব্যাপক হারে বেড়েছে মোটরসাইকেল। যার বড় কারণ এই রাইড শেয়ারিং পেশার প্রসারে। তা ছাড়াও যানজট এড়িয়ে নিরাপদ ও দ্রুত যাতাযাতের জন্য অনেকেই বেছে নেন বাহনটি।

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব বাইকারদেরই যাত্রীদের হেলমেট সাধারণ মানের। এসব হেলমেট প্লাস্টিকের এবং আবরণ একদম পাতলা। যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানহীন এই হেলমেট কোনো কাজেই আসবে না।

অনেকেই বলছেন, যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য ভারী হেলমেট দরকার। কারণ সবকিছুর আগে জীবনের নিরাপত্তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর নয়তো হালকা হেলমেটে আঘাত লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যাবে। এতে যাত্রীর মৃত্যু ঘটতে পারে।

 

রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং করেন আসলাম। খিলক্ষেত লা মেরিডিয়ানের সামনে তিনি যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি নিজে ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করছিলেন। তবে যাত্রীর জন্য রেখেছিলেন নিম্নমানের একটি হেলমেট।

কথা বলে অজুহাত দাঁড় করান আসলাম।

‘পাতলা হেলমেটগুলো নেওয়ার একটা কারণ কম দামে পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয়ত ভালো হেলমেট থাকলে চুরি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য ভারী হেলমেট ব্যবহার করা জরুরি। কিন্তু বেশির ভাগ চালকই পাতলা প্লাস্টিকের হেলমেট ব্যবহার করেন।’

দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকায় রাইড শেয়ারিং করেন শামীম ওসমান। তিনিও আসলামের মতো নিজে উন্নতমানের হেলমেট ব্যবহার করছেন। তবে যাত্রীর জন্য রেখেছেন মানহীন হেলমেট। কথা হলে তিনিও যাত্রীদের ওপর দোষ চাপান।

‘যাত্রীদের নিরাপত্তা তো তারাই (যাত্রীরা) বুঝে না, আমরা কীভাবে বুঝতে পারব।’

‘যাত্রীরা ভাড়া পারলে কমিয়ে দেয়, তাহলে কীভাবে তাদের জন্য দামি হেলমেট রাখব। এ ছাড়া বেশির ভাগ যাত্রী হালকা হেলমেট চায়। তারা এটা ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করেন। তাই হালকা হেলমেট রাখি।’

যাত্রীদের নিরাপত্তা ও ভালো হেলমেটের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি রেগে যান।

তিনি বলে উঠেন, ‘আপনি এত ভালো হেলমেটের কথা বলছেন, যাত্রীদের জন্য বেশি মায়া হলে আমাকে একটা হেলমেট কিনে দেন। তাহলে আমি সেটা দিয়ে যাত্রীদের সেবা দিব।’

নামমাত্র হেলমেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চালক মোহাম্মদ আলামিন বলেন, ‘আমি ২ মাস ধরে ঢাকায় বাইক চালাই। আমি ভারী হেলমেট ব্যবহার করতাম আগে। কয়েকদিন আগে হারিয়ে গেছে। আমার কাছে নিজের জীবনের মতো যাত্রীদের জীবনও মূল্যবান। কারণ সবাই ঢাকায় কর্মের জন্য এসেছি। সবারই পরিবার আছে।’

তবে ব্যতিক্রম পাওয়া গেছে মোহাম্মদ রিয়াদ হোসাইনকে। তিন বছর ধরে তিনি ঢাকায় মোটরসাইকেল চালান।  শুরু থেকেই তিনি ভারী হেলমেট ব্যবহার করছেন বলেও জানান।

‘আমার কাছে চালক ও যাত্রী উভয়ের জীবনের সুরক্ষা প্রয়োজন। কারণ একটি দুর্ঘটনা শুধু একজনকেই কেড়ে নেয় না, পুরো পরিবারকে একদম পথে নামিয়ে দেয়। আর পরিবারের একজনকে হারানোর ব্যথা কোনোকিছুর বিনিময়ে ফিরে আসবে না।’

হাসান মাহমুদ একজন চাকরিজীবী। ঢাকায় রাইড শেয়ারিং শুরু হওয়ার পর থেকেই মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। তার বাসা মালিবাগ। আর অফিস বনানী। এই পথ যাতায়াতে রাইড শেয়ারের সহযোগিতা নেন তিনি।

তার অভিযোগ, হেলমেটের বিষয় নির্দিষ্ট করা না থাকায় চালকরা পছন্দমতো ব্যবহার করেন।

‘আমি পাতলা ও ভারী দু’ধরনের হেলমেট দিয়ে যাতায়াত করছি। নিজ থেকে সব সময়ে চেষ্টা করি ভালোমানের হেলমেটে ব্যবহার করে এমন বাইকে উঠতে’, বলেন তিনি।

‘আসলে যেকোনো বিষয়ে আইনের পাশাপাশি নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। নিজের জীবন ও নিরাপত্তার কথা নিজেকেই ভাবতে হবে।’

 

ইমরান মাহমুদ নামের আরেক যাত্রী বলেন, ‘ঢাকায় বসবাস করার কারণে যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মোটরসাইকেলে যাতায়াত করি। তবে বেশির ভাগ চালককে দেখা যায় যাত্রীদের জন্য মানহীন হেলমেট রাখেন আমাদের জন্য।’

‘মাঝে মধ্যেই এই কারণে চালকদের সঙ্গে জগড়া হয়। এগুলো তো হেলমেট না, ক্যাপ বলা চলে। বেশির ভাগ হেলমেট লুজ, ফিতা কোনো মতে পেঁচিয়ে চলতে হয়। আবার বাইক চলার সময় জোরে বাতাসে মাথা থেকে সরে পেছনে চলে যায়’, বলেন ইমরান।

এই যাত্রীরা আরও বলেন, হেলমেট মস্তিষ্কের গুরুতর আঘাত থেকে রক্ষা করে। হেলমেট পরিধান করে দুর্ঘটনার সময় মৃত্যুর ঝুঁকি কমে।

‘তবে এসব মানহীন হেলমেট কতটুকু আপনাকে সুরক্ষা দিবে? আমি যদি নিরাপত্তার জন্যই হেলমেট পরি তাহলে হালকা কেন পড়ব। এসব পাতলা হেলমেট পরে দুর্ঘটনার শিকার হলে হেলমেট ভেঙে প্লাস্টিকের টুকরো মাথায় ঢুকে যাবে। এর চেয়ে এসব হেলমেট না পরে খালি মাথায় থাকা ভালো বলে মনে করি।’

অনেকেই বলছেন, ভারী হেলমেট ব্যবহারে চালক ও যাত্রীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

তবে আইনে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। মোটরযান আইন চলাচল আইনের ৪৯-চ ধারায় বলা হয়েছে, মোটরসাইকেলে যাত্রা করতে হলে চালক ও যাত্রীদের মাথায় হেলমেট বাধ্যতামূলক। কারোর হেলমেট না থাকলে তিন মাসের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনে হেলমেটের স্পষ্ট ধারণা না থাকার সুযোগ নিচ্ছেন মোটর আরোহীরা। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলেও মনে করেন তারা।