ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

কর্ণফুলী টানেল

দেড় বছরে আয় ৮৫ কোটি, ব্যয় ১৯১ কোটি

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৫, ১১:৫৭ পিএম
ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধনের পর গত দেড় বছরে কর্ণফুলী টানেলে রাজস্ব (টোল) আদায় হয়েছে ৫৪ কোটি ৭২ লাখ ৮৫ হাজার ৭০০ টাকা। আর টানেল রক্ষণাবেক্ষণে কর্তৃপক্ষের ব্যয় হয়েছে ১৯১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধনের পর থেকে চলতি বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই টানেলে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১৩৬ কোটি ৫২ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকা। গড়ে প্রতিদিন ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হলেও আয় হয়েছে মাত্র ১০ লাখ ৫২ হাজার ৪৭৩ টাকা।

কোনোরকম সমীক্ষা ছাড়া অপরিকল্পিত টানেল নির্মাণের কারণে বিপুল পরিমাণে লোকসান হলেও কর্ণফুলী নদীর ওপারে পরিকল্পিত নগর ও শিল্পায়ন, চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ এবং মাতারবাড়ী প্রকল্প, ডিপ সি পোর্টকে এই ট্যানেলের সাথে সম্পৃক্ত করা গেলে ‘নোনাজলে পোঁতা মরা তিমিকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞসহ টানেল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞদের দাবি, টানেল সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ এবং মেরিন ড্রাইভের সাথে সংযুক্ত লিংক রোডগুলো নির্মাণ না করে টানেল উদ্বোধনের কারণে অর্থনীতিকে সচল করতে নির্মাণ করা এই টানেল ‘মরা হস্তি’তে পরিণত হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত কর্ণফুলী টানেল দিয়ে ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯০১টি ছোটগাড়ি (কার, জিপ, পিকআপ) চলাচল করেছে। দৈনিক গড়ে ৩ হাজার ৪৫১টি। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৭৪.১১ শতাংশ। বাস দুই লাখ আট হাজার ২৩১টি। গড়ে দৈনিক ৪৮৪টি। লক্ষ্যমাত্রার ১০.৪০ শতাংশ ট্রাক ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৯টি। গড়ে দৈনিক ৬৭৯টি। লক্ষ্যমাত্রার ১৪.৫৮ শতাংশ। ট্রেইলর চলাচল করেছে ১৮ হাজার ২৪০টি। গড়ে দৈনিক ৪২টি। লক্ষ্যমাত্রার ০.৯১ শতাংশ।

চলতি বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত ছোটগাড়িতে টোল আদায়ের পরিমাণ ৩১ কোটি ৩৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৫৭.২৫ ভাগ। বাসে সাত কোটি এক লাখ সাত হাজার ১০০ টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ১২.৮১ ভাগ। ট্রাকে ১৪ কোটি ৫৭ লাখ পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার ২৬.৬২ ভাগ। ট্রেইলর চলাচলে টোল আদায় হয়েছে এক কোটি ৮১ লাখ ৪২ হাজার ২০০ টাকা যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ০৩.৩১ ভাগ।

টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত গড়ে দৈনিক ৩ হাজার ৮৫১টি গাড়ি চলাচল করলেও সেতু কর্তৃপক্ষের দাবি এই টানেলকে লাভজনক করতে হলে দৈনিক ১৮ হাজার ৪৮৫টি যানবাহন চলাচল করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, আয় বাড়াতে না পারলে টানেল নির্মাণে নেওয়া বিদেশি ঋণের কিস্তি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। সেজন্য ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে শহর বাইপাস করে মেরিন রোড দিয়ে টানেলমুখি করা জরুরি। এজন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহযোগিতাও চেয়েছেন তারা।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’ শীর্ষক টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেয় আওয়ামী সরকার। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। তবে নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় আট হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ছয় হাজার ৭০ কোটি টাকা চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় সাবেক সরকার।

অভিযোগ রয়েছে, পতিত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার শাসনামলে মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট হয়। প্রতিটি প্রকল্পে দফায় দফায় বাড়ানো হয় ব্যয়। এই টানেল নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের মোট ব্যয় হয় তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। অথচ চীনে এই ধরনের টানেলে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।

আরও অভিযোগ রয়েছে, টানেল নির্মাণের আগে চীনা ঠিকাদারের সমীক্ষায় দিনে ২০ হাজার ৭১৯টি যানবাহন চলাচলের কথা বলা হয়। একই সাথে প্রতিবছর এই হার মূল লক্ষ্যমাত্রার সাথে ৬.৪ শতাংশ যোগ হওয়ার কথাও জানিয়েছিল তারা। ২০২৫ সালে দৈনিক গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচলের কথা বলা হয়েছিল সে সমীক্ষায় এবং ২০৩০ সালে সংখ্যা দাঁড়ানোর কথা দৈনিক প্রায় ৩৮ হাজার। তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, লোক দেখানো এই প্রকল্পের পুরোটাই ছিল কথার ফুলঝুরি। নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের ঘামের অর্থ হাতিয়ে নিতেই ‘টানেল’ নির্মাণের মতো অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সাবেক সরকার।

তিনি বলেন, টানেল না করে কালুরঘাট ব্রিজসহ কক্সবাজার সড়ক ৬ লেনে করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু সে প্রস্তাব আমলে না নিয়ে টানেলের দিকে সাবেক সরকারের আগ্রহ ছিল বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, টানেল চালু হলেও দুই পাড়ে সংযোগ সড়কসহ পর্যাপ্ত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। প্রশস্ত করা হয়নি সংযোগ সড়কও। তিনি আরও বলেন, টানেলকে লাভজনক করতে হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে মীরসরাই থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক অত্যন্ত জরুরি। একই সাথে কক্সবাজার ও মাতারবাড়ী প্রকল্পকে টানেলের সঙ্গে যত দ্রুত যুক্ত করা যায় ততই মঙ্গল। না হয় লোকসানের ভারে এই টানেল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

টোল হার কমানোর দাবি জানিয়ে এই পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়ক ফোর লেইন না হওয়ায় টানেল হয়ে চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে যানজটে আটকা পড়তে হচ্ছে। তা ছাড়া টোলের হার বেশি হওয়ায় অনেক যানবাহন বিশেষ করে ভারী যানবাহন টানেল এড়িয়ে চলছে। যে কারণে গত ১৮ মাসে ভারী যানবাহনের দৈনিক গড় হার মাত্র ০.৯১ শতাংশ। নোনাজলে পুঁতে রাখা মরা তিমিকে বাঁচিয়ে তুলতে হলে নদীর ওপারে (আনোয়ারা) শহর সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি বলে জানান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার। একই সাথে চায়না ও জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ একাধিক শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার দাবিও জানান তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং ফেনীর বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠা দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলেও তেমন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি।

জানতে চাইলে টানেল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ বলেন, টানেলের মতো মেগা প্রকল্পে লাভ-লোকসানের হিসাব কষতে সময় দিতে হবে। শত বছরের পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা এ প্রকল্প থেকে এক-দুই বছরে লাভ আশা করাটা বাস্তব সম্মত নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, অনেক অপূর্ণতা নিয়েই এই টানেল চালু করা হয়েছে। যেহেতু বড় অংকের অর্থ ব্যয় করে টানেলটা চালু করা হয়েছে সেহেতু টানেল বন্ধ করে দিলে এর সমাধান হবে না। টানেলটা বন্ধের চিন্তা না করে বরং কীভাবে লাভজনক করা যায় আমাদের সেই পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা হাতে নিতে পারলে অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে কর্ণফুলী টানেলÑ এমন মন্তব্য করেন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা এই প্রকৌশলী।

মীরসরাই মেরিন ড্রাইভের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে শহর বাইপাস করে মেরিন রোড দিয়ে টানেল মুখি করা জরুরি। একই সাথে সংযোগ সড়কগুলো দ্রুততার সাথে নির্মাণ এবং প্রশস্ত করতে হবে। কর্ণফুলী টানেল অর্থনীতির বিশাল কর্মযজ্ঞ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, টানেলকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে হলে, নদীর ওপারে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলাসহ বাঁশখালি-চকরিয়া ৪ লাইন সংযোগ সড়কের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।