কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে প্রায় ছয় যুগ ধরে (১৯৪৭ সাল) ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান। গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) পেহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন নিহতের পর সেই উত্তেজনায় যেন ঘি পড়েছে।
ঘটনার পরপরই কোনো তদন্ত ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। পাকিস্তানও যথারীতি দায় অস্বীকার করেছে। ভারতের অভ্যন্তরে যেকোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটলে কোনো তদন্ত ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
পেহেলগামের এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে দু’দেশ সীমান্ত বন্ধ, ‘সার্ক’ ভিসা বাতিলসহ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর, পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনাও ঘটিয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিকদের মধ্যেও মাথাচাড়া দিয়েছে প্রতিশোধের নেশা। প্রকাশ্যে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। বসে নেই পাকিস্তানও। সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত নিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছে দেশটি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে সিন্ধু চুক্তি স্থগিতকে ‘পানিযুদ্ধ’ বলে মন্তব্য করেন পাকিস্তানের বিদ্যুৎ মন্ত্রী আওয়াইজ লেখারি। পাকিস্তান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, পেহেলগামের এ হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বরং ভারত নিজেরাই হামলার এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে পাকিস্তানকে ফাঁসানোর জন্য।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দু’দেশের এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, একে অপরের বিপক্ষে নেওয়া সিদ্ধান্ত আর সীমান্তে দু’দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে হওয়া গোলাগুলির ঘটনা যুদ্ধের দিকেই ধাবিত করছে ভারত-পাকিস্তানকে।
সংবাদমাধ্যম দ্য ডন জানিয়েছে, ভারতের পানি–সন্ত্রাসবাদ বা সামরিক উসকানিসহ যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে পাকিস্তান পুরোপুরি প্রস্তুত। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীও সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। পাক বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানের মহড়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এ থেকে বুঝতে বাকি নেই যে, ভারতকে মোকাবিলায় শক্ত অবস্থান নিয়েছে ইসলামাবাদ।
পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতিতে মুসলিম ও সনাতন ধর্মালম্বীদের মনে আশঙ্কা জেঁকে বসেছে ‘গাজওয়াতুল হিন্দের’।
বিশেষ করে বিজেপি নেতাদের অসংলগ্ন ও আগ্রাসী বক্তব্য— রীতিমতো ভারতের অভ্যন্তরেই মুসলিমদের জন্য চরম বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিয়েছে। পেহেলগামের ‘সন্ত্রাসী’ হামলার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজেপি নেতা-কর্মীদের মুসলিমবিদ্বেষী আক্রমণাত্মক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে। যাতে নিজেদের ‘হিন্দুর বাচ্চা’ উল্লেখ করে ‘মুসলমানদের শেষ করার’ ঘোষণা দিতে দেখা গেছে।
এমনকি ভারতে মুসলিমবিদ্বেষ ভয়ংকর মাত্রার। বিশ্বপরিমণ্ডলে এ নিয়ে তুমুল নিন্দিত নয়াদিল্লি। সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ ও নারকীয় নির্যাতনের জন্য সেখানে কোণঠাসা হয়ে রয়েছে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কিত ওয়াকফ বিল, দেদার্চে মসজিদ-দরগাহ ভাঙচুর, মুসলিম উচ্ছেদ, মসজিদে আজান নিষিদ্ধসহ প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। আলেম-ওয়ালারা এসব ঘটনার রেশ টেনে ‘গাজওয়াতুল হিন্দের’ বিষয়ে সতর্ক বাণী জানাচ্ছেন।
ইসলাম ধর্মমতে, ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ হবে কাফের বা মুশরিকদের সঙ্গে মুসলমানদের পৃথিবীর ভেতর বৃহৎ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হিন্দুস্তানের মোট মুসলিমদের এক তৃতীয়াংশই নিহত হবেন, আরেক অংশ পালিয়ে যাবেন আর শেষ অংশ যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। শেষে তারাই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করবেন।
গাজওয়া শব্দের অর্থ হলো অভিযান আর হিন্দ হলো স্থানের নাম। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় বর্তমান ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানকে বলা হতো হিন্দ। অর্থাৎ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে বলা হতো হিন্দ বা হিন্দুস্তান।
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এর আগেও একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। সীমান্ত, চোরাচালান, জঙ্গি বা সন্ত্রাসী নিয়ে দু’দেশের মধ্যে প্রায়ই বাকযুদ্ধ লেগে থাকে। ওদিকে আফগানিস্তানের সঙ্গেও ভারতের বৈরিতা বেশ পুরোনো। গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা ছিল।
কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। অন্যান্য প্রতিবেশী চীন, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারের সঙ্গেও দেশটির সম্পর্ক অহি-নকুল। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় বিষয় বিবেচনায় পাক-ভারত উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিই যে ‘গাজওয়াতুল হিন্দের’ আভাস— তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
তবে ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ এরই মধ্যে হয়ে গেছে না কি ভবিষ্যতে হবে— তা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কারো মতে, ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খিলাফতের আমলে মোহাম্মদ ইবনে আল-কাসিমের সিন্ধু আর মুলতান বিজয় ছিল এ গাজওয়াতুল হিন্দের শুরু। যা পরবর্তীকালে দিল্লি সুলতান আমল ও সর্বশেষ মুঘল আমল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
আবার কারো মতে, এ বিজয় এখনো বাকি। ইমাম মাহদির আগমনের পর বা আগে হবে এ বিজয়।
আপনার মতামত লিখুন :