মাঠপর্যায়ে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে পুলিশ বাহিনী। গত দেড় দশকে এ বাহিনীতে বিপুলসংখ্যক নতুন পদ সৃজন ও নিয়োগ দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বাংলাদেশ পুলিশে মোট ৮৩ হাজার ৭০টি নতুন পদ সৃজন করা হয়। কিন্তু এ দেড় দশকে শুধু কনস্টেবল, এসআই ও পুলিশ সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জনকে, যা মোট পুলিশ সদস্যের প্রায় অর্ধেক।
রাজনৈতিক ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের এ নিয়োগের বড় অংশই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। শেখ হাসিনা সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে মূলত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে।
সাবেক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ পুলিশ সংগঠিত হয়। এই বাহিনী পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধ পুলিশের ট্রাডিশনাল চরিত্রে বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়। পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় হলো ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, বেশ কয়েকজন এসপিসহ প্রায় সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্য বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে জীবনদান করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকেই প্রদেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব হারিয়েছিল পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার। যুদ্ধের সময় পুলিশের বীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ঢাকার রাজারবাগের পুলিশ লাইন্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল .৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
সম্প্রতি এসব বিষয়ে কথা হয় পুলিশের সাবেক আইজি আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। সেই পুলিশ বাহিনীকে অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করা হয়েছে। পুলিশ আজ নানা সংকটকে। সাধারণ মানুষ পুলিশ দেখলেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করছে। শেখ হাসিনা সরকার তাদের স্বার্থের জন্য গোটা পুলিশ বাহিনীকে আজ কলঙ্কিত করেছে। হয়তো পুলিশ এসব সংকট কাটিয়ে এক সময় ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার দায়িত্বটা কি নিবে।
সাবেক আইজি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ঘটনার জন্ম নিয়েছে। আর এ বিষয়টি ভালো করেই বুঝতে পেরেছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। এদিকে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ সংকট নিরসনে পুলিশকেই সামনের দিকে এগিয়ে আসতে হবে এবং জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য তাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে গত দেড় দশকে পুলিশ বাহিনীর পরিবর্তন নিয়ে গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে পুলিশের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৫ হাজার ৯২৫ জন কনস্টেবল, ১১ হাজার ৫১০ জন এসআই ও ২ হাজার ৪৮৪ জন পুলিশ সার্জেন্টকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। তাদের মধ্যে এসআই ও সার্জেন্ট পদে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে। এ মেয়াদে এসআই পদে ৪ হাজার ৯০৮ জন এবং সার্জেন্ট পদে ৭২৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০০৯-১৩ সময়কালে এসআই পদে ৩ হাজার ৭৫১ ও সার্জেন্ট পদে ৪২৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪-১৮ সময়কালে এসআই পদে ২ হাজার ৮৪৫ ও সার্জেন্ট পদে ৪২৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ দেড় দশকে দেশে ৬৪টি নতুন থানা, ৯৭টি তথ্যকেন্দ্র ও একটি ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া দেড় দশকে পুলিশের জন্য মোট ২ হাজার ৭৬০টি পিকআপ, ৫২৪টি জিপ, ৩৫৪টি ট্রাক, ১৩টি এপিসি, ১৭৮টি জলযান এবং ৭ হাজার ৬৩৪টি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্রও আধুনিকায়ন করা হয়।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল থেকেও একাধিকবার উদ্বেগ জানানো হয়েছে। তবে সর্বশেষ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্বিচারে গুলির ঘটনা জনরোষ তৈরি করে। এর ধারাবাহিকতায় গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশের বিভিন্ন থানায় পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট এক দিনে সারা দেশে ৪৫০টিরও বেশি থানা আক্রান্ত হয়। এর আগে ৪ আগস্টেই মৃত্যু হয় ১৪ জন পুলিশ সদস্যের। আহত হয়েছিল ৩০০ শতাধিক। এসব ঘটনার জেরে পুলিশকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ রেখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে যান নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তারা। ফলে দেশের সব থানাসহ ট্রাফিক পয়েন্টগুলো কার্যত ফাঁকা হয়ে যায়। এরপর থমকে যায় গোটা পুলিশ বাহিনী।
ছাত্র আন্দোলন ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা আরও আগেই চলে গেছে। আ.লীগ সরকারের আমলে দেখা যেত মানুষ তখনই পুলিশের কাছে যেত, যখন তার আর উপায় থাকত না। কিন্তু তখনো দেখা যেত যে, ভুক্তভোগী পুলিশের সহায়তা পাচ্ছে না, বরং অপরাধীকেই পুলিশ রক্ষা করে। ফলে মানুষ পুলিশের ওপর থেকে আস্থা সরিয়ে ফেলে। আগস্টের পর এ পর্যন্ত আমরা পুলিশের প্রতি এখনো জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখছি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হবে না। পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে কাজ করবে। এজন্য পুলিশ সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশকে কোন প্রক্রিয়ায়, কীভাবে ও কাদের অন্তর্ভুক্ত করে সংস্কার করা হবেÑ সেটা নির্ধারণ করবে পুলিশ সংস্কার কমিটি।
প্রাথমিক কমিটির সুপারিশ ও মতামত গ্রহণ করে এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া হবে এবং পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। সে সময় ইউএনডিপি ও আগ্রহী অন্যান্য দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করে তাদের মতামত এবং পরামর্শ গ্রহণ করা হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, পুলিশ সংস্কার এমনভাবেই হবে যেন, জনগণ পুলিশের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারে। ঠিক এভাবেই পুলিশ পেশাদার আচরণের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াবে।
এ বিষেয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেছেন, প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে পেশাদার হতে হবে। অপেশাদার হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশ মনোবল শক্ত করে দেশের স্বার্থে দেশের মানুষের স্বার্থে সব সংকট মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।
আইজিপি বলেছেন, পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করে বলা আছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। পুলিশ সদস্যদের কল্যাণে যা যা করা দরকার তাই করা হবে। জনগণকে পেশাদারত্বের সাথে সেবা দিতে হবে।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহিদুর রহমান বলেছেন, পুলিশ অবশ্যই বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী। পুলিশ ছাড়া আসলে এই সমাজ ব্যবস্থা চিন্তা করা যায় না। যে ক্রাইসিসে আমরা পড়েছি সেটি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আশা করি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ জনগণের বন্ধু হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই অসংখ্য পুলিশ নিয়োগ ও অপব্যবহার হয়। যার কারণে পুলিশ আজ জনবিচ্ছিন্ন ও নানা ধরনের সংকটে পড়েছে। পুলিশ সংকটে পড়ার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটি হলো- জনসেবা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা। যার ফল ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশ ভোগ করেছে। তবে, পুলিশ যদি জনকল্যাণে সংস্কার না হয়ে আবারও আগের মতো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হয় তাহলে সামনের দিনে পুলিশকে ভয়াবহ সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :