ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪
ভিআইপিরা রিমান্ডে আসছেন-যাচ্ছেন

দুর্নীতি-অপকর্ম স্বীকার করলেও দায় চাপাচ্ছেন হাসিনার ওপর

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২৪, ১২:২৫ এএম

দুর্নীতি-অপকর্ম স্বীকার করলেও দায় চাপাচ্ছেন হাসিনার ওপর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আমলারা বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছেন। তাদের গোয়েন্দারা দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার বান্ধবী তৌফিকা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জামিন-মামলা ও নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের কথা স্বীকার করেছেন। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন রিমান্ডে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, শেখ হাসিনার আনুকূল্য পেতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে অধীনস্থদের গুলির নির্দেশ দেন।

বহিষ্কৃত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) ৫ আগস্টের আগে সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন সিস্টেম নষ্টের কথা গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও গোয়েন্দারা।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তিন মাস হলো, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীরা আত্মগোপনে থাকাবস্থায় হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। গত দেড় দশকে রাষ্ট্র ও জনগণকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো নেতা বা আমলারা এখন গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে, রিমান্ড শেষে কারাগারে, কারাগার থেকে ফের রিমান্ডে, মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো। এভাবেই ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে জুলাই-আগস্ট হত্যাযজ্ঞের মামলার আসামি হাসিনার সহচরদের। আর এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কারা কর্তৃপক্ষ, আদালতপাড়া সরগরম। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পলাতক দোসরদের গ্রেপ্তারে দিন-রাত কাজ করছে বাহিনীগুলো, মিডিয়া উইং থেকে প্রতিনিয়ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গ্রেপ্তারের তথ্য জানানো হচ্ছে। অভিযান চালিয়ে ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সাম্প্রতিক মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও গোয়েন্দারা বলছেন, পুলিশি রিমান্ডে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীরা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নানান অপরাধ-অপকর্ম, গুম-খুন-নির্যাতন, দমন-পীড়ন, দুর্নীতির ফিরিস্তি দিচ্ছেন। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তারা হাসিনার নির্দেশ পালনের কথা বলছেন। আবার নিজেদের অপকর্ম-দুর্নীতির কথাও স্বীকার করেছেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক প্রভাবশালী নেতাকর্মী এবং সাবেক-বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন বা হচ্ছেন। তাদের অধিকাংশ পৃথক পৃথক মামলায় বারবার রিমান্ডে আসছেন আবার কারাগারে ফিরে যাচ্ছেন। আবারও তাদেরকে অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তদন্তের স্বার্থে রিমান্ড চেয়ে আদালতে তোলা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে একাধিক প্রভাবশালী গৎবাঁধা জবাব দেওয়ায় তাদের আবারও রিমান্ডে আনা হচ্ছে।

ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তের স্বার্থে রিমান্ডে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করা হয় না। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে চার্জশিটের মাধ্যমে আদালতে জমা দেওয়া হয়।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার গ্রেপ্তার ভিআইপি আসামিরা পুলিশের রিমান্ডে তারা চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য দিয়েছেন। পুলিশি জেরার মুখে মামলাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে কেউ গৎবাঁধা উত্তর দিচ্ছেন। আবার কেউ এড়িয়ে যাচ্ছেন, কেউ কৌশলী হয়ে চুপ থাকছেন। অনেকে জবাবে বলছেন ওপরের নির্দেশ পালন করেছি।

নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরির কথা অকপটে গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। কীভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ লোপাট হতো, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, কমিশন বাণিজ্য, ব্যাংক ও আর্থিক খাত লুটপাটের  সবিস্তারে বলছেন। 

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাযজ্ঞ এবং অন্যান্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। গতকাল বুধবার সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বান্ধবী এবং ব্যক্তিগত ক্যাশিয়ার তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, গত দু-তিন মাসে গ্রেপ্তারকৃত ভিআইপিরা বেশির ভাগ হত্যা মামলায় রিমান্ডে ছিলেন। অনেকে রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছেন। বর্তমানে কতজন রিমান্ডে রয়েছেন তার সঠিক হিসাব দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আসছে এবং যাচ্ছে, এটি চলমান প্রক্রিয়া। তদন্তের প্রয়োজনে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রতিটি মামলার তদন্ত শেষে দ্রুতই চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফৌজদারি মামলার তদন্তের বাইরে  দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) আলাদা করে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানান দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার এবং নানাৎ অপরাধের তদন্ত করছে। গ্রেপ্তারকৃতদের পরিবার বা ব্যাবসায়িক সংশ্লিষ্টদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া, ব্যাংক হিসাব বা দুদকে তলব করা হচ্ছে।

বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছেন যারা সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক রাজধানীর পৃথক দুই মামলায় আট দিন, সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী দুই দিন, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ধানমণ্ডি থানার মামলায় তিন দিন ও বংশাল থানার মামলায় চার দিনের, বহিষ্কৃত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান নিউমার্কেট থানার মামলায় পাঁচ দিন, ধানমণ্ডি থানার হত্যা মামলায় হাসানুল হক ইনু এবং চকবাজার থানার মামলায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।

এ ছাড়া গান বাংলার কৌশিক হোসেন তাপস এবং অভিনেত্রী শমী কায়সার তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।

ডিএমপির একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার  সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত প্রায় তিন মাসে গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ আমলের ভিআইপি নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন। বর্তমানে যারা রিমান্ডে রয়েছেন বা সম্প্রতি সময়ে রিমান্ডে ছিলেন, তাদের সবাই বিভিন্ন হত্যা মামলার আসামি। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি জড়িত ছিলেন তারা।

স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পদে দায়িত্বরত থাকাবস্থায় গ্রেপ্তারকৃতরা ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞে কেউ নির্দেশদাতা আবার কেউ সরাসরি অস্ত্রহাতে গুলি চালান।

গ্রেপ্তারকৃত পতিত সরকারের প্রভাবশালীরা হত্যাযজ্ঞ এবং গত দেড় দশকে নানান অপকর্মে জড়িত থাকার কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। মামলার তদন্তের স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করছেন না। আদালতে সঠিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে কাজ করছেন।

ডিএমপি সূত্র জানায়, রিমান্ডে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকিতে। প্রশাসন বা বাহিনীর শীর্ষ সাবেক কর্মকর্তাদের বেশ সতর্কতার সাথে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাদের শীতাতপ (এসি) নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা হয়েছে। খেতে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি থেকে আসা খাবার। এ ছাড়া রাজনৈতিক ভিআইপিদের যে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে আনা হয়েছে, সেই মামলার এজাহার অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রতিটি মামলার এজাহার অনুযায়ী যেসব আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন, রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে এবং ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে।

জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য ডিজিটাল এবং লিখিত ডকুমেন্ট তৈরি করা হচ্ছে আদালতে পেশ করার জন্য।

কারাগার সূত্র জানায়, কারাগারে রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সরকারি আমলারা সব সময় বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সেটা ক্ষমতা বা অর্থের বিনিময়ে। বিরোধী দল বা ক্ষমতার বাইরে থাকা নেতাকর্মী  এবং সাবেক আমলা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর তাদের সহায়তা করেন অসাধু কারা সদস্যরা। অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করে অর্থের লোভে প্রভাবশালীদের সহায়তা করে থাকেন কারা সদস্যরা। স্বৈরাচার হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের অনেকেই পুলিশি রিমান্ডে রয়েছেন। আবার অধিকাংশ রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে অনেককে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই আদালতের আনুকূল্য পেয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।

গত দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা গ্রেপ্তারের পর একাধিক মামলায় একাধিকবার রিমান্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে যাদের ভূমিকা বেশি ছিল তাদের মধ্যে এরাই ছিলেন অন্যতম। এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দোসর এবং আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারি আমলাসহ দলটির শতাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া সারা দেশে কয়েক হাজার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে, আবার অনেকে রিমান্ডে রয়েছেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!