ঢাকা রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ছদ্দবেশি ও মাস্টারমাইন্ড মশিউর

মেহেদী হাসান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪, ১০:৩৩ এএম

ছদ্দবেশি ও মাস্টারমাইন্ড মশিউর

ফাইল ছবি

► জাল নোটের মাস্টারমাইন্ড ছিল পুলিশ কর্মকর্তা মশিউর
► একাধিক মামলায় অভিযুক্ত আসামি মশিউর
► পুলিশের পোশাকের আড়ালে ভয়াবহ এক অপরাধী ছিল মশিউর
জাল নোটের ‍‍‘মাস্টারমাইন্ড‍‍’ ছিল পুলিশ কর্মকর্তা মশিউর রহমান। শুধু জাল টাকা না, জঙ্গি নাটকের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অনেকেই তাকে জানতেন। তিনি নাম ফোটাতে মিডিয়া ব্যবহার ও পরিচিত আসামিদের ধরে নিজেই ছাড়িয়ে আনতেন। মানুষের সাথে করতেন অভিনব প্রতারণা। ডিবি পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ডিবির একটি বিশেষ সূত্র রুপালী বাংলাদেশকে জানায়, মশিউর ঢাকাসহ সারা দেশে জাল নোট তৈরির কাজে নিজের হাতে তৈরি করা কারবারিদের ব্যবহার করতেন। দেশের অধিকাংশ জাল নোট তৈরি চক্রের মূলহোতা ছিলেন নিজেই। অভিযোগ আছে- মশিউর নিজের নাম ফোটানোর জন্য বহুল আলোচিত মামলার আসামিদের ধরতে না পেরে পরিচিত অপরাধীদের চুক্তিতে গ্রেপ্তার করতেন এবং নিজেই ছাড়িয়ে আনতেন। পোশাকের আড়ালে এসব অসংখ্য অপকর্ম করতেন পুলিশের এই অসাধু কর্মকর্তা।

বৃহস্পতিবার পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমানকে আটক করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে আটক করে তাকে ঢাকা নিয়ে আসে গোয়েন্দা পুুলিশ। মশিউর রহমান দীর্ঘ সময় ঢাকা মহানগর পুলিশে ডিবিতে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ লালবাগ জোনের উপকমিশনার (ডিসি) ছিলেন তিনি। অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিও পেয়েছিলেন। ডিবি সূত্র জানায়, ছাত্র আন্দোলনসংশ্লিষ্ট একাধিক মামলায় মশিউরকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে। এসব মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ৭ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।

সূত্র মতে, ভাসমান মানুষদের ধরে বিভিন্ন আলোচিত মামলার আসামি করতে এবং সেটা গণমাধ্যমে ব্যাপক ভাবে প্রচার করা হত। মানুষকে বোঝাতে চাইতেন সে অনেক ট্যালেন্ট অফিসার। এসব বিষয়ে অনেক সময় সন্দেহ হলে সাংবাদিকরা যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যেতেন। গণমাধ্যমকে টিশুর মত ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে মশিউর। অনেক সময় ভুল তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করত।

জানা যায়, মশিউর নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেক সময় আসামি ধরে এনে ১০-১৫ দিন বা তার বেশি নিজ ক্ষমতা বলে আয়না ঘরে ও তার নিজস্ব টর্চার সেলে আটকে রাখতেন। আসামিকে আদালত হাজির করার একদিন আগে অথবা ঐদিন টেলিভিশনের নিজস্ব (পরিচিত) কিছু সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে নিজের মনগড়া নাটক অর্থাৎ ভুল তথ্য প্রচার করতেন।

এছাড়া ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদকে দিয়ে ভিন্ন মিথ্যা বার্তা তুলে ধরতেন। হারুন ও মশিউরের কাছে ডিবি পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা তুচ্ছহীন ছিল। সাংবাদিকরা যদিও মাঝে মাঝে মশিউর ও হারুনের অপপ্রচার বুঝে প্রশ্ন করলেন ডিবি থেকে বলা হতো, কাল থেকে আপনাদের কোন সংবাদের তথ্য দেওয়া হবে না। এসব ভয়ভীতি দেখিয়ে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করা হতো। কোনো সাংবাদিক যদি তাদের বিরুদ্ধে যেতে তাহলে তাকে ডিবি অফিসে ডেকে বিভিন্ন হুমকী ধামকী দেওয়া হতো।

মশিউরের মিথ্যা মামলার খপ্পরে পরে ৭ মাস জেল খটেছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রী নেতা বাইজিদ আহমেদ। তিনি জানান, আজ পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোর পিছনে মশিউরের মতো এমন বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তারা রয়েছে। সে সদ্য বিদায়ী সরকারের দালালিতে অভ্যস্ত ছিল। মশিউরের মতো পুলিশ কর্মকর্তারা ভুলে গিয়েছিল যে তারা জনগণের বন্ধু। আজ পুলিশ এসমস্ত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সত্যিকারের জনগণের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছে। যেটা আগামীর বাংলাদেশের জন্য শুভ লক্ষণ। আমি মশিউরের শাস্তি চাই।

বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক নেতারা রুপালী বাংলাদেশকে অভিযোগ করেন- মশিউর বিএনপি-জামাতের দায়িত্বশীল নেতাকর্মীদের ফাঁদ পেতে ধরে এনে নগদ টাকা নিত। বনিবনা না হলে মিথ্যা মামলা ও অধিকাংশ সময় জঙ্গি বলে নিযার্তন করতেন। পুলিশের পোশাকের আড়ালে ভয়াবহ এক অপরাধী ছিল মশিউর।

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক মশিউরের সঙ্গে দীর্ঘদিন ডিউটি করা এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মশিউর আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন অবৈধ্য কাজে সহযোগিতা করত। তার উদ্দ্যেশ্য ছিল অবৈধ্য পথে কোটি কোটি টাকা রোজগার করা। পুলিশের চাকুরি ছেড়ে অবসর সময়ে এমপি ও হতে চেয়েছি মশিউর। যেটা পুলিশের অনেক সদস্যরা জানতেন।

জানা যায়, মশিউর ছাত্রজীবনে একটি রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে আ. লীগ সরকারের সময় নিজেকে অতিরিক্ত আওয়ামী-লীগার হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তৎকালীন সরকারের নির্দেশে অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরেণের গুজব অপপ্রচার ছড়িয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক তৈরি করতেন।

চুক্তিতে মানুষের পাওয়া টাকা তুলে দিতেন মশিউর

সূত্র জানায়, পুলিশ কর্মকর্তা মশিউর বড় বড় ব্যবসায়ীদের পাওয়া টাকা তুলে দিতেন এবং সেটার জন্য কমিশন নিতেন। তিনি পুলিশের অত্যন্ত ট্যালেন্টেড অফিসার হিসেবে পরিচিত। এরপরও অবৈধ সম্পদ অর্জনের লোভে সামলাতে পারেননি। অধিকাংশ সময় পুলিশ পরিচয়ের থেকে আ. লীগ সমর্থিত অফিসার হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। অসংখ্য মানুষের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। তাছাড়া সে শেখ হাসিনা সরকারের সময় গুম খুনের মাস্টারমাইন্ড ছিল এবং এর সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। আ. লীগ সরকারের আমলে সে একটি আয়না ঘরের প্রস্তাবক ও দায়িত্বে ছিলেন।

একাধিক মাঠের সংবাদ কর্মীরা অভিযোগ করেন- মশিউরের অপরাধ এখানেই শেষ নয়। তিনি অনেক সময় সাংবাদিকদের চোখের সামনে মানুষকে অত্যাচার করতেন এবং বিএনপি জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করতেন। কিছু কিছু সাংবাদিক মশিউরের অনুমতি ছাড়া গ্রেপ্তারের সংবাদ প্রচার করলেই, সেই সাংবাদিককে ফোন করে হুমকি ধামকি ও অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতেন। তিনি নিজেকে বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভাবতেন। মশিউরের বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। ফরিদপুরে এলাকায় তার যথেষ্ট সুনাম কিন্তু পুলিশের পোশাকের আড়ালে সন্তানের এমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে তার বাবা সুনাম আজ নষ্টের পথে।

হত্যা মামলায় অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর ৭ দিনের রিমান্ডে

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমানের ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। আর যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মাজহারুল ইসলামকে পাঠানো হয়েছে ৫ দিনের রিমান্ডে। দুই জনকে পৃথক দুই হত্যা মামলায় রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেন এ আদেশ দেন। এর আগে মশিউরের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফ আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক এ আদেশ দেন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, মশিউরকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আশা করি গুরুত্বপর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। রিমান্ডে শেষে এসব জানানো হবে।

আরবি/জেআই

Link copied!