বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ব্যাংকের অসহযোগিতা এবং দুদকের টার্গেট মামলার খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন বিএনপিপন্থি অনেক ব্যবসায়ী। অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভবিষ্যৎ। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এখন ঘুরে দাঁড়াতে চান এই ব্যবসায়ীরা। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতির শক্তি। স্থবির অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দ্রুত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল করতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিগত সরকার দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ঢোল পেটালেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে কাঁচামাল আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি বিগত ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচার করেছেন।
সরকারের পতনের পর দুর্নীতিবাজেরা পালিয়েছে। মূলত তারাই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এবং বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারকে বিশ্বাসযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে।
বিগত সরকারের সময়ে প্রতিহিংসার শিকার বাংলাদেশের একটি কৃষিভিত্তিক ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান নীলসাগর গ্রুপ। গ্রুপটি ‘কাজ করি দেশ গড়ি’ স্লোগান নিয়ে ২০০৮ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক শেডের মাধ্যমে সহজলভ্য পোলট্রি, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইনকিউবেটরের মাধ্যমে উৎপাদিত এক দিন বয়সের ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন, পোলট্রি ও ফিশ ফিড তৈরি করে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশে চাহিদা পূরণ করে আসছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, দিগন্ত বিস্তৃত শেড, দৃষ্টিসীমার বাইরে এপাশ-ওপাশ। দেখে মনে হতে পারে হাজার হাজার মানুষের কর্মযজ্ঞ চলছে ভেতরে। বাস্তবতা ঠিক তার উলটো, চারপাশে কেবল সনসান নীরবতা, যেন পরিত্যক্ত কোনো জনপদ।
নীলফামারীর বিভিন্ন উপজেলায় নীলসাগর গ্রুপের নীলসাগর এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এমন ছয়টি কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন ৫ লাখের বেশি ডিম উৎপাদন হতো। মুরগির বাজারে স্বস্তি ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিল বেশ কয়েকটি ফার্ম, যা দিয়ে পূরণ হচ্ছিল উত্তরবঙ্গসহ দেশের আমিষের চাহিদা। এ ছাড়া এখানে সপ্তাহে প্রায় ৫ লাখের মতো বাচ্চা উৎপাদন হতো। তবে এর সবগুলোই এখন মন খারাপের একেকটি উপাখ্যান।
এই প্রতিষ্ঠানে ওয়ার্কার্স, স্টাফ ও সিকিউরিটি গার্ড মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জনশক্তি কর্মরত ছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসা ও দমন-পীড়নের ফলে ২০১৮ সালের পর খামারটি বন্ধ হয়ে যায়, বেকার হয়ে পড়েন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখন এটা আবার চালু হবে, নতুন করে কর্মোদ্দীপনা পাবে এবং এলাকার লোকজনও এখানে কাজ করবে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর।
নীলসাগর গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আহসান হাবীব লেলিন বলেন, ‘বিগত লম্বা সময় রাষ্ট্রীয় বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি, চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছি। পাশাপাশি মিথ্যা মামলা-হামলা ও চাঁদাবাজি করা হয়েছে আমাদের ওপর। ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। প্রতি মুহূর্তে তাদের নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগেছি।’
তিনি বলেন, ‘একটা প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য রাষ্ট্র যদি শত্রু মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিতে তাকায়, তাহলে এটা নিয়ে এগোনো খুবই কঠিন কাজ, যেটা আমরা অনুভব করেছি। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে আমরা আশা করি বর্তমান সরকার একটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান ধরে রাখার স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে আমাদের যতটুকু প্রাপ্য সেটুকু সহযোগিতার প্রত্যাশা করি।’
আহসান হাবীবের মতো শত শত বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা অর্থনীতি সচল রাখতে গড়ে তুলেছিলেন কলকারখানার ঘূর্ণায়মান চাকা। কিন্তু সব হারিয়ে নিজেরাও এখন অচলপ্রায়। তাদের ব্যবসার দ্বার উন্মোচনে দ্রুত সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা, আর্থিক ব্যবস্থা যাদের ভেঙে পড়েছে, কারখানা চালানোর জন্য তাদের সহযোগিতা করতেই হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এ ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সহাভূতিশীল। তিনি বলেন, ‘এখনকার যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলতে পারেন। তারা ব্যাংকের কাছে গিয়ে বলতে পারেন যে এই এই কারণে ক্ষতি হয়েছে, আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। এটা আমরা ব্যাংকগুলোকেও উৎসাহিত করব।
বাংলাদেশ ব্যাংকেরও একটা সেল আছে। যদি কেউ মনে করে তার ন্যায্য দাবি পূরণ হচ্ছে না বা সেবা পাচ্ছেন না, তাহলে সেই সেলে অভিযোগ করতে পারেন। আমরা অবশ্যই সেটা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
আপনার মতামত লিখুন :