ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

বিমান কর্মকর্তা শিশিরের দাপট

মাইনুল হক ভূঁইয়া ও দেলোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২৪, ১০:৪১ পিএম

বিমান কর্মকর্তা শিশিরের দাপট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বিমানের কর্মকর্তা শ্রমিক লীগের নেতা শিশির বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি কোটা আন্দোলন চলাকালীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল ও নানকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে মানব পাচার, লাগেজ পাচার, শিশু হত্যার মতো অভিযোগ রয়েছে। তার স্ত্রীর নামে রয়েছে অবৈধ ট্রাভেল ব্যবসা। সরকারি ফোন ব্যবহার করার অভিযোগও  উঠেছে। সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন এই শিশির।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিজানুর রহমান শিশির একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। দুদকে তার নামে মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। তার বাড়ি পটুয়াখালী। মাত্র এইচএসসি পাশ করে তিনি বিমানের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। পরবর্তীকালে প্রাইভেট পরীক্ষায় ডিগ্রি পাশ করে বিমানের ট্রাফিক শাখায় যোগদান করেন। বিমানের বিভাগ পরিবর্তন করার তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিমানবন্দরে কাজ করে বিভিন্ন রকম অনৈতকভাবে অবৈধ অর্থ উপার্জন করে ভাগ্য পরিবর্তন করা, যার শুরু সেই ২০০৪ সালের দিকে সিলেটে পোস্টিং নিয়ে যাত্রীদের ব্যাগেজ পাচার করার মাধ্যমে।

পরবর্তীকালে ঢাকা ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে  শ্রমিক লীগের নেতাগিরি করে সহকর্মীদের অন্যায়ভাবে বদলি, মানব পাচার, বিমানের রাজস্ব চুরি, সোনা চোরাকারবারি থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই, যা শিশির করেননি।

অফিস ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। কখনো ডিউটি পোস্টে করতেন না। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন শ্রমিক লীগের নেতা হিসেবে সর্বোচ্চ অনৈতিক সুবিধা ভোগ করতেন। ২০১৯ সালে বিমান কর্তৃপক্ষ তাকে অন্যায় কাজের শাস্তিস্বরূপ সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বদলি করে দিলে সেই সময়ের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা নানক ও তোফায়েল আহমেদের হাতে-পায়ে ধরে তদবির করে সিলেটে পোস্টিং নেন। সিলেটে  যাওয়ার পর থেকেই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
সিলেটের যাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি করা এবং কেউ তার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট না করলে বৈধভাবে পাওয়া ভিজিট ভিসা থেকে শুরু করে যেকোনো ভিসায় বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে চরমভাবে অসহযোগিতা এবং অন্যায় আচারণ করতেন বলে শোনা যায়।

আওয়ামী পরিচয়ে তিনি সিলেটের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের আত্মীয়স্বজনকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বিমানকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, যা তদন্ত করলেই বের হয়ে আসবে। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থা ও এজেন্সি তার সম্পর্কে সব তথ্য খতিয়ে দেখছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে তিনি তার ফেসবুকে চরম কট্টরবাদী পোস্ট দিয়ে সর্বজনীন এই আন্দোলনের বিষয়ে বাজে কথাবার্তা লেখেন।
শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে মিজানুর রহমান শিশির তার ফেসবুক ওয়াল থেকে পোস্টগুলো ডিলিট করে ফেলেন। কিন্তু মুহূর্তে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন লোকজন তা সংরক্ষণ করে রাখে।

জানা যায়, তার নামে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি মামলা চলমান আছে। সর্বশেষ এই কোটা আন্দোলন যখন সফলতার দিকে এগাচ্ছে, মিজানুর রহমান শিশির সিলেট থেকে আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন।

জানা গেছে, এই মিজানুর রহমান শিশির সাবেক আইজিপি বেনজীর ও দুর্নীতিবাজ মতিউরের একই আত্মা। মিজানুর রহমান শিশির বিমানের একজন জুনিয়র গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থা ও এজেন্সি তার সম্পর্কে সব তথ্য জানে। ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে তার এসব কাজের সহযোগী ছিলেন তৎকালীন বিমান শ্রমিক লীগ সভাপতি এবং বর্তমানে বিমানের কানাডাস্থ স্টেশন ম্যানেজার মশিকুর রহমান, জুনিয়র গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার জি এম জাকির।

জুনিয়র গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার সাখাওয়াত হোসেন বর্তমান শ্রমিক লীগ তথা বিমান সিবিএর সাধারণ সম্পাদক। গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট  আজিজুর রহমান বর্তমানে ঢাকা এয়ারপোর্টের বিমানের ডমেস্টিক সেকশনে কর্মরত আছেন। তার আরও অন্যতম সহযোগী ছিলেন সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের তৎকালীন স্টেশন ম্যানেজার এবং বর্তমানে বিমানের জেদ্দাস্থ স্টেশন ম্যানেজার আবদুস সাত্তার। উল্লেখ্য, এই আব্দুস সাত্তার হচ্ছেন পুলিশের ডিআইজি আব্দুল বাতেনের বড় ভাই।

অভিযোগ সম্পর্কে জানার জন্য মিজানুর রহমান শিশিরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করেছি, আমার চৌদ্দগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ করে।’ তিনি জানান, লাগেজ কাউন্টারে তিনি ছিলেন না। সুতরাং লাগেজ পাচারের প্রশ্নই ওঠে না।

শিশির বলেন, ব্যাগেজ বিনিময় নীতিমালার আলোকে ২০১৯-২০২৪ পর্যন্ত তার নেতৃত্বে ২৬ কোটি টাকা উপার্জন হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যশোহর বিমানবন্দরে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। এবার কোথায় দেয়, দেখি।’

আরবি/জেডআর

Link copied!