ঢাকা বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

লুটেরাদের নীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংককে সুরক্ষার চেষ্টা

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০১:১৬ এএম

লুটেরাদের নীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংককে সুরক্ষার চেষ্টা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো সুরক্ষায় শুদ্ধাচার ফেরানোর চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নীতি সুরক্ষা ও পাচারের অর্থ ফেরাতে ইতিমধ্যে ব্যাংক কমিশনও গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ২০১৯ সালে গঠিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সেই বিতর্কিত প্রজ্ঞাপন এখনো বাতিল করেনি সরকার, যার কারণে রাষ্টায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নীতি সুরক্ষার নামে লুটেরা নীতি বহাল। অন্যদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগসহ পাচারের পথও খোলা রয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে বৈষম্য সৃষ্টি করছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

২০১৯ সালের আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় মহাব্যস্থাপক পদে পদোন্নতি ও পদায়ন করত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বোর্ড। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর প্রজ্ঞাপনের আলোকে আওয়ামী সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের সুপারিশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে পদায়ন ও পদোন্নতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করে।

প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চুক্তিভিত্তিক), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), জিএম পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তাদের মধ্যে উঠেছে অসন্তেষের ঝড়। তবে রূপালী ব্যাংকে এ নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই।

প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকাররা রিট আবেদন করলেও অদৃশ্য কারণে তা স্থগিতাদেশ দেন আদালত। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২২ আগস্ট অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা বরাবর তিন ব্যাংকের পক্ষ থেকে গেজেট নিষিদ্ধ করতে আবেদন করা হলেও সাড়া মেলেনি। এ সম্পর্কে অনেক তথ্যচিত্র এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

তিন ব্যাংকের নির্বাহীদের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ব্যাংকে শুদ্ধাচার ফেরাতে সাবেক সরকারের গেজেট নিষিদ্ধ করা হোক। ২০১৯ সালের আগে ব্যাংকের বোর্ড যেভাবে পদোন্নতি, পদায়ন ও নিয়োগ করে, সেই কর্মী ব্যবস্থাপনা ফিরিয়ে দেওয়া হোক। তাহলে ব্যাংক নীতিমালায় শুদ্ধাচার ফিরবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রজ্ঞাপনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার ১৪/২০১৮-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও আন্তর্বর্তী সরকার আমলে নেয়নি, যার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের নির্বাহীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

প্রজ্ঞাপন অনুসারে সরকারি ব্যাংকের ২৫৮ কর্মকর্তার ভাইভা নেওয়া ইতিমধ্যে শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ। চলতি নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ থেকে পদোন্নতির সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু হয়েছে এবং আজ বুধবার শেষ হচ্ছে। তবে সংবেদনশীল এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক কথা বলতে রাজি হননি।

তবে পদোন্নতি ও নীতিমালা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, পদোন্নতির বিষয়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাশ বাধ্যতামূলকসহ কিছু নীতিমালা এখনো বহাল রয়েছে। তবে ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে নীতিমালা চাপানো আখ্যায়িত করে বাতিল চেয়ে গভর্নর বরাবর যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেই সব দাবি যাচাই-বাছাই চলছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিটিও করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন : ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ বা পদোন্নতি ও পদায়নের নীতিমালা জারি করা হলো।

নীতিমালা ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা-২০১৯’ নামে অভিহিত করা হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন সম্পন্ন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে বাছাই : অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশ এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। বাছাই কমিটিতে থাকবেন অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়), গভর্নর (বাংলাদেশ ব্যাংক), সিনিয়র সচিব/সচিব (অর্থ বিভাগ), সিনিয়র সচিব/সচিব (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ), অতিরিক্ত সচিব (ব্যাংক প্রশাসন) ও যুগ্ম সচিব (বাণিজ্যিক ব্যাংক), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের দাবি : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যাংকিং খাতে বৈষম্য সৃষ্টিকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারির (৫৩,০০,০০০০.৩১২.২২.০০২.১৯-৩) প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হোক। জিএম ও ডিএমডি স্তরের নির্বাহীদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নিজ ব্যাংকে ফেরত দিয়ে সব গ্রেডে ক্ষতিগ্রস্ত ও পিছিয়ে পড়া কর্মকর্তা ও নির্বাহীদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রদান চাই। 

২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলারে (নং-১১) রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডিএমডি ও জিএম পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নিজ ব্যাংকে ন্যস্ত করে।

পরে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর বিআরপিডি সার্কুলার (নং-১৪) জারি করে কেবল ডিএমডি পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপনে (৫৩,০০,০০০০.৩১২.২২.০০২.১৯-৩) জিএম পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির কার্যক্রম আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ন্যস্ত করে।

২০১৯ সালের ১৭ জুলাই আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, যা ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা ও হতাশা তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার ১৪/২০১৮-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় ১১ নভেম্বর আগের নির্দেশনা বাতিল করে। সেখানে উল্লেখ করা হয় ‘৩ (ঘ)’ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মহাব্যবস্থাপক পদে নিজ ব্যাংক পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ ও পদায়ন সম্পন্ন করবে।’

সেই নির্দেশনা অনন্তর্বর্তী সরকারকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, বৈষম্যমূলক পদোন্নতির নীতিমালা সংশোধন ও বাতিলের প্রতিকার চেয়ে ইতিপূর্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবেদন করা হলেও তারা বিষয়টি অগ্রাহ্য করেছেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!