বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ্যডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী মাধবী দেবনাথ পুত্র অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথ। তিনি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। বরগুনার মাতুব্বর, তিনিই ছিলেন অপরাধ জগতের আসল বন্ড। শহরে বিশাল ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীও ছিলেন সুনাম দেবনাথ। গত ১৫ বছরে বাবার ছত্রছায়া ও দাপটে সুনাম দেবনাথ হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজে গড়ে তুলেন বিশাল সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন। অবৈধভাবে কামাই করে বনে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। ক্ষমতার দাপট আর ভয়ে এদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেত না বলে এলাকাবাসী সূত্রে অভিযোগ মিলেছে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরও প্রতি বিপ্লবের ষড়যন্ত্রে শহরে বিশাল মিছিল সমাবেশের নেতৃত্ব ছিলেন সুনাম দেবনাথ। জাহাঙ্গীর কবিরের গ্রেপ্তারের পরই গা ঢাকা দেন সুনাম। দুদক থেকে শম্ভু ও সুনামের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধানে নামে। বরগুনার এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পিতাপুত্র আত্মগোপনে চলে গেলেও পিতা শম্ভু হন গ্রেপ্তার। পুত্র সুনাম দেবনাথ এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এক যুগের সময় ধরে বরগুনার উপকূল ও নদীপথে মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালানের রুট হিসেবে গড়ে ওঠে। কক্সবাজার, টেকনাফ চট্টগ্রাম রুটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি বেড়ে উঠলে নিরাপদ তালতলীর সমুদ্র সৈকত শুভ সন্ধ্যা, টেংরাগিরি সৈকত, মরানিদ্রা, নিদ্রা, ফকিরহাট মৎস্য বন্দর, বরগুনার সোনাতলা, বাবুগঞ্জ, নলী, পালের বালিয়াতলী, ছোনবুনিয়া, চালিততলী ও গোলবুনিয়াসহ নদী পারের এলাকাগুলো রুট হিসেবে বেছে নেয় মাদককারবারি ও চোরাকারবারিরা।
এ সুযোগে অপরাধ জগতের সব নিয়ন্ত্রণ নেয় পিতা-পুত্র। মাদক ও চোরাকারবারিদের যুবরাজ সুনাম দেবনাথ কামিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করতেন তার বৌয়ের চাচাতো ভাই শাওন তালুকদার ও শীর্ষ সন্ত্রাসী অভিজিৎ তালুকদার এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সিন্ডিকেটের অন্যতম ডান হাত। ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে ছিল বৌয়ের আপন ভাই রনি তালুকদার। এ ছাড়া মাদক ব্যবসায় ও কিশোর গ্যাংয়ে ছিল সানি, ড্যাফোডিল প্রিন্স, কবি আসাদ, অয়ন মীর, তারাকান্দা রাজু, মাহাবুব, হিমেল, শিবা, প্রত্যয়, প্রান্ত, চোরা রাজীবের ভাই সোহেল, হাত কাটা জাহাঙ্গীর, শুভ খান, জিন্নাত খান, মনির, রাজা মেম্বার।
বরগুনার মাদক ও চোরাচালানের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত সুনাম দেবনাথ। কিশোর গ্যাং ও ছাত্রলীগের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করত সুনাম। ২০১৯ সালে চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড ও কিশোর গ্যাং লিডার নয়ন বন্ড ক্রসফায়ার ঘটনা ছিল মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। রিফাত শরীফ ও নয়ন বন্ড মূলত ছিল তার সাম্রাজ্যের অনুসারী। নয়ন বন্ড তার বগলে থেকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করত আর রিফাত শরীফ তার ডান হাত জনের হয়ে কাজ করত। এ নিয়ে তৎকালীন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রুবাইয়াত আদনন অনিক সুনাম দেবনাথের দিকে আঙুল দেখিয়ে গণমাধ্যমের কাছে এক সাক্ষাৎকার বলেন, বরগুনায় মাদকটা চালায় কে? মাদকের পেছনে কে জড়িত? নয়ন বন্ড কার আশ্রয় প্রশ্রয়ে এতদূর এসেছে? বরগুনার রাজনীতিতে শম্ভু ও তার পুত্রের প্রভাবশালী হতে তাদের মতাদর্শের বাইরের নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে দলের বাইরে ও কর্মকাণ্ডে বিচ্ছিন্ন করে রাখত।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি চতুর্থবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়ার কিছুদিন পর শম্ভু তাঁর স্বেচ্ছাচারিতায় ছিটকে পড়তে থাকে নেতাকর্মীরা। এরপর তারাও ফুঁসে উঠতে থাকে শম্ভুর বিরুদ্ধে। সংবাদ সম্মেলন করে এবং কেন্দ্রে অভিযোগ করে শম্ভুর বিরুদ্ধে। এ সময়ে শম্ভু কিছুটা দলে কোনঠাসা হতে শুরু করলে তার পুত্র সুনাম দেবনাথ আধিপত্য বিস্তার করতে অপরাধ চক্র গড়ে তুলে। অপরাধ চক্রের বিভিন্ন অপরাধীরা যোগ দেয় সুনাম সংঘে। শহরে চলতে থাকে রমরমা মাদক বিক্রি, বেড়ে ওঠে কিশোর গ্যাং। ধ্বংসের দিকে চলে যায় বরগুনার যুব সমাজ। বিগত কয়েক বছর বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের কমিটির নেতৃত্ব ছিল ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বিপরীত গ্রুপে। এ কারণে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো ছিল সুনামের ভিন্ন কৌশলমাত্র।
ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার ছেলের এসব অপরাধের বিচার চেয়েছেন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌশিকুর রহমান ইমরান। রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে বলতে গিয়ে ইমরান বলেন, বরগুনার সব অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার ছেলে সুনাম জড়িত ছিল। তাদের কারণে আওয়ামী লীগ বরগুনায় কলঙ্কিত। বরগুনায় আওয়ামী লীগের দুর্গ হওয়া সত্ত্বে¡ও নৌকা পরাজিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধাচারণ। দুর্নীতি আর লুটপাট করে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ায় আমদের মতন সাধারণ নেতাকর্মীদের আড়ালে থাকতে হচ্ছে এদের কারণে।
এ বিষয়ে হুমায়ূন হাসান শাহীন বলেন, সুনাম দেবনাথ ছিল মাদকের গডফাদার। তার বাবার ক্ষমতায় বরগুনায় যুবসমাজের মধ্যে মাদক ছড়িয়ে দিয়েছে। কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করে হত্যাকাণ্ডের মতো অনেক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড এই মাদক নিয়েই সংঘটিত হয়েছে। আমরা এ ধরনের সব অপরাধের জন্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার ছেলে সুনাম দেবনাথসহ সব অপরাধীর বিচার দেখতে চাই।
আপনার মতামত লিখুন :