ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

রাজনীতির বলয়ে বেসিস

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪, ০৯:৪৭ পিএম

রাজনীতির বলয়ে বেসিস

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিস’কে রাজনীতিকরণের অভিযোগ করেছেন সংগঠনটির সদস্যরা। সদস্যদের অভিযোগ, সংস্কারের নামে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এমন কয়েকজনকে বেসিসের নির্বাচনি সহায়ক কমিটিতে রাখা হয়েছে। সহায়ক কমিটির এসব সদস্য ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এমনকি কারো কারো বিরুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগও রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক এই সংগঠনকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন এই খাতের শীর্ষ পর্যায়ের উদ্যোক্তারা।

জানা গেছে, বেসিসের সর্বশেষ নির্বাহী কমিটি বাতিল করে গত ৪ ডিসেম্বর সংগঠনটিতে প্রশাসক নিয়োগ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মেহেদী হাসানকে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। বেসিসের নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন আয়োজনে গত ৮ ডিসেম্বর ১১ সদস্যবিশিষ্ট সহায়ক কমিটি গঠন করেন প্রশাসক ড. মেহেদী।

তারা হলেন, উল্কাসেমি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান; ডিএনএস সফটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাফেল কবির; নিউরোসফট টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান; ইনফোব্যান রিয়েল্ম আইটি সলিউশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফৌজিয়া নিগার সুলতানা; ড্রিম টেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন নিজামী; ই-বিজনেস সফট সলিউশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুস সাহাদাত; সলিউশন ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ ইবনে নুরুল ইসলাম; টেকসল টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রওশন কামাল জেমস; টাচ অ্যান্ড সলভ টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরুল কায়েস পরাগ; ম্যাটিওরস ডট কমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাইন বিল্লাহ এবং এইচ আর সফট বিডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম রোকমুনুর জামান রনি। পরবর্তীতে আরও চারজনকে যুক্ত করা হলে বর্তমানে সহায়ক কমিটিতে মোট ১৫ জন সদস্য রয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, কমিটির সদস্যদের মাঝে ইমরুল কায়েস পরাগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার আত্মীয়। বিষয়টি পরাগ নিজেই হোয়াটস অ্যাপ বার্তায় লিখেছেন আরেকজন বেসিস সদস্যকে। সেই চ্যাটের স্ক্রিনশট রয়েছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে। বিষয়টি প্রতিবেদকের কাছে স্বীকারও করেছেন ইমরুল কায়েস। তবে ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।

এই কমিটির চেয়ারম্যান রাফেল কবির একসময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

রাফেল কবির রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নব্বই এর গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ইকসু) জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম।

সহায়ক কমিটির কো-চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ছাত্রদলের সহসভাপতি পদমর্যাদার নেতা ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন শুনে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে কথা বলবেন জানালেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

কমিটির আরেক সদস্য নাজমুল শাহাদাত শিবিরের ছাত্রনেতা ছিলেন। যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি স্বীকার করলেও সাংগঠনিক পরিচয় নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। তবে বেসিসে আওয়ামীপন্থি কারও স্থান হবে না বলে প্রতিবেদককে বলেন তিনি। কমিটির একমাত্র নারী সদস্য ফৌজিয়া নিগার সুলতানা শিবিরের ছাত্রী শাখার নেত্রী ছিলেন।

সহায়ক কমিটির কতিপয় সদস্যদের এমন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাধারণ সদস্যরা। তাদের দাবি বেসিসের কোনো পর্যায়ের কমিটিতেই কখনো এমন রাজনীতিকরণ করা হয়নি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সংগঠনটির এক সদস্য বলেন, দেশের ডিজিটালাইজেশনে সংগঠনের অনেক অবদান রয়েছে। বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে বেসিসে সবসময় দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারাই ছিলেন। কিন্তু এবারের ঘটনা নজিরবিহীন। মনে হচ্ছে, এটা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের পরিচয় নিতে যাচ্ছে।

অন্যদিকে সহায়ক কমিটিতে থাকা সদস্যদের বেসিসের আসন্ন নির্বাহী পরিষদ নির্বাচনে সুযোগ থাকায় স্বচ্ছ নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে সাধারণ সদস্যদের। নির্বাচন আয়োজনে যারা সহায়তা করবেন তারাই যদি নির্বাচন করেন তাহলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে মত  অনেকের।

কমিটির সদস্য ইমরুল কায়েস পরাগ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কমিটির সদস্যদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তো তারা নির্বাচন করতেই পারেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সহায়ক কমিটির সদস্যদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত না।

এ বিষয়ে বেসিসের সাবেক সভাপতি ও টেকসই অর্থনীতির ভিত তৈরিতে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ফাহিম মাশরুর ফাহিম মাশরুর বলেন, সহায়ক কমিটির উচিত নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করা। কিন্তু নির্বাচনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন ভোটার তালিকা প্রণয়ন ইত্যাদির মতো কাজে তাদের সংশ্লিষ্ট থাকা উচিত না। এ ধরনের বিষয়গুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রশাসকের কার্যালয় এবং বেসিস সচিবালয়ের দেখভাল করা উচিত। 

পাশাপাশি সহায়ক কমিটির সদস্যদের বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ফাহিম বলেন, কীসের ভিত্তিতে কমিটির সদস্যদের রাখা হয়েছে সেটি একটি প্রশ্ন। বাছাই প্রক্রিয়া কী ছিল আমরা কিন্তু জানি না।

পাশাপাশি কোনো বাণিজ্য সংগঠনকেই রাজনীতিকরণ করা উচিত নয় বলে মনে করেন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক সৈয়দ আলমাস কবীর। 

রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে সরকারের সাথে এক ধরনের ‘এলবো ডিসেটেন্স’ রেখে সম্পর্ক পরিচালনা করতে হয়। অর্থাৎ সেই সম্পর্ক খুব আন্তরিক ও স্বার্থের হবে না, আবার খুব দূরত্ব থাকবে এমনটাও না। এজন্য শুধু বেসিস না, কোনো বাণিজ্য সংগঠনকেই রাজনৈতিক বলয়ে আনা উচিত হবে না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় বেসিসের প্রশাসক ও আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মেহেদী হাসানের সঙ্গে। দেশের বাইরে থাকায় হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করে প্রশ্ন পাঠানো হয়। এরপর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে বেসিস প্রশাসকের কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। গত রোববার বেসিস সদস্য তৌফিকুল করিম সুহৃদের রিট আবেদনের শুনানি শেষে এই আদেশ দেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। পাশাপাশি বেসিসের নির্বাচিত পর্ষদ ভাঙা এবং প্রশাসক নিয়োগ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না সেটি জানতে চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিটিও উইংয়ের মহাপরিচালককে কারণ দর্শানোর রুল জারি করেছেন বেঞ্চ।

আরবি/জেডআর

Link copied!