শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ১২:৩৩ এএম

ভিক্ষুকের নগরী ঢাকা

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ১২:৩৩ এএম

ভিক্ষুকের নগরী ঢাকা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে রিকশাচালক রমিজের। প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে অনেকটা ক্লান্তও। ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট চান রমিজ। চায়ে চুমুক দিতেই পেছন থেকে একটা ছোট্ট হাতের স্পর্শ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই একটা শিশু হাত বাড়িয়ে বলে ‘তাকা (টাকা) দাও, ভাত খাব।’ তাকে দেখে মায়া হয় তার। পকেট থেকে ১০ টাকার নোট দিতেই দৌড়ে চলে যায়। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের কাছে টাকাটা দিয়ে ঘুরে অন্য একটা দোকানে যায় সে। ঘটনাটা গতকাল বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায়। মাঝ বয়সি খুশি বেগম। স্বামী নিখোঁজ থাকায় মেয়েকে কোলে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিকেই অবলম্বন করে চলছে তার জীবন। শুধু ওই শিশু আর খুশিই নন, ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকা, সড়ক, ফুটপাত, ট্রাফিক সিগন্যাল কিংবা পাড়া-মহল্লা বাদ নেই কোথাও। ভিক্ষুক চারিদিকে। ভিক্ষুকদের পাশাপাশি রয়েছে হকার, হিজড়া ও কিশোরদের উপদ্রব। এদের অনেকে অন্য কাজের জন্য সক্ষম হলেও ভিক্ষাবৃত্তিতেই স্বাচ্ছন্দ্য। ফলে প্রায় প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনায় ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে সড়কে যাতায়াতকারী নগরবাসীকে।

এক যুগেরও বেশি সময় আগে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল ও পুনর্বাসনের জন্য একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেই উদ্যোগের সুফল পাওয়া যায়নি আজও। রাজধানীর কূটনৈতিক জোনসহ কয়েকটি এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হলেও এখন সেখানেই চলছে ভিক্ষাবৃত্তি। ফলে ভিক্ষুকমুক্ত শুধু খাতা-কলমেই।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ে কিছু মানুষের কর্মবিমুখতা এবং একদল স্বার্থান্বেষী মহলের অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটছে। গোটা শহরের হিসাব ধরলে ভিক্ষুক বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ।

ভিক্ষুকমুক্ত করতে মাঝেমধ্যেই পুলিশ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হয়। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ভিক্ষুকদের। এদের কাউকে কাউকে অন্য পেশায় ফেরালেও কৌশলে তারা আবার ফিরছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। দেশের ভিক্ষুকদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে। তবে গত কয়েক মাসে রাজধানীতে ভিক্ষুকদের উপদ্রব বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। শিশু, কিশোর, বৃদ্ধসহ নানা বয়সিদের দেখা যাচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চক্র। চক্রটি ভিক্ষাকে বাণিজ্যের অনুষঙ্গ বানিয়েছে। ভিক্ষুকদের আটক করা হলেও তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে ফের ভিক্ষায় নামিয়ে দেয়। ভিক্ষার টাকার একটি অংশ চলে যায় এসব চক্রের পকেটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। কিছু মানুষের কর্মবিমুখতা ও একদল স্বার্থান্বেষী মহলের অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তির উপদ্রব বাড়ছে। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণ ঘটেছে। ভিক্ষাবৃত্তির লজ্জা থেকে দেশকে মুক্ত করার সময় এসেছে।

গত কয়েক দিন ঢাকা শহরের গুলিস্তান, পল্টন, পান্থপথ, বিজয় সরণি, ধানমন্ডি, গুলশান-বনানী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ট্রাফিক সিগন্যাল পড়তেই ভিক্ষুকদের দল নেমে পড়ে। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। রয়েছে শিশুরাও। হাত পেতে সিগন্যালে আটকে পড়া পথচারীদের কাছে ভিক্ষা চাইতে দেখা যায়। কখনো একজন, কখনো দল বেঁধে ধরে পথচারীদের। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হয় পথচারীরা। এরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পথচারীদের ধরে আর সিগন্যাল পড়লে বাস, রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনের যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা চায়।

গত বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম পাশের রাস্তায় ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায় মান্ডার বাসিন্দা খুশি বেগমকে।

খুশি বেগম এই প্রতিবেদককে জানান, অন্যের অটোরিকশা চুরি করে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ তার স্বামী। তাই বাধ্য হয়ে তিনি ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন। ভিক্ষা ছেড়ে দিয়ে বাসাবাড়িতে কাজ কর্ম করতে পারেন না এমন প্রশ্ন করতেই সটকে পড়েন মধ্যেবয়সি ওই নারী। পান্থপথে ভিক্ষা করেন বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম। তার গ্রামের বাড়ি বারিশাল সদরে। ঢাকার ডেমরায় ছেলের সঙ্গে বাস করেন। তিনি জানান, ছেলের সংসারে টানাপোড়েন। তাই ভিক্ষা করে তিনি কিছুটা সাপোর্ট দেন।

এক প্রশ্নের উত্তেরে তিনি বলেন, বয়স্ক মানুষ। অনেক টাকার ওষুধ খেতে হয়। সব সময় তো আর ছেলেমেয়ের কাছে টাকা চাওয়া যায় না।

গতকাল বিকালে বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে শিশুকন্যাকে নিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য টাকা চাইছেন আসমা বেগম নামে এক নারী। তিনি জানান, তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। ঢাকার বনানী কাঁচাবাজারে তার স্বামী থাকেন। গত কয়েক দিন স্বামীর ফোন বন্ধ পেয়ে ঢাকায় খুঁজতে এসেছেন। কিন্তু সন্ধান না পেয়ে ভিক্ষা করছেন। এক পথচারী জানান, ওই নারীকে প্রায়ই এই এলাকায় দেখা যায়। এরা মিথ্যা গল্প সাজিয়ে মানুষকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে টাকা রোজগার করে।

জুরাইনের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম জানান, বাচ্চার জন্য এক হালি কলা কিনতে দাঁড়িয়েছি। তিনজন সামনে এসে হাজির। তিনজনকে ৫ টাকা করে দিলেও ১৫ টাকা। এক হালি কলা কিনেছি ২০ টাকায়। কেনাকাটা বা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার সময় প্রায়ই দু-তিনজন করে সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চায়। বিষয়টি খুবই বিব্রতকর।

রহিমা বেগম (৪০) তিন সন্তান নিয়ে থাকেন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। প্রায় পাঁচ বছর আগে তার স্বামী মারা যান। এরপর বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করতেন। সেই কাজ চলে গেলে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন তিনি। সেই থেকে ভিক্ষাবৃত্তিকেই অবলম্বন করে চলছে তার জীবন। এমন অনেক সালেহা অন্য পেশা ছেড়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন। মহানগরীর জনাকীর্ণ স্থানগুলোয় কিছুক্ষণ দাঁড়ালে বা নগরীর ট্রাফিক সিগন্যালে ১০-১২ জন ভিক্ষুকের মুখোমুখি হতে হয়। 

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজধানীসহ সারা দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ২০১০ সালে পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয় সরকার। লক্ষ্য, ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৩ সালে রাজধানীর বিমানবন্দর, সোনারগাঁওসহ গুরুত্বপূর্ণ সাতটি এলাকা চিহ্নিত করে এগুলোকে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এসব এলাকা থেকে অনেক ভিক্ষুককে তার নিজ এলাকায় ফেরত পাঠানো হয় পুনর্বাসনের জন্য। তাদের দোকান বা ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য আর্থিক সহায়তা, রিকশা-ভ্যান কিনে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা হয়। কর্মসূচির শুরু থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ভিক্ষুক পুনর্বাসনে ৭৫ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে সরকার। এ ছাড়া গত ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ৩ হাজার ৫০ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসনে বরাদ্দ রয়েছে ১২ কোটি টাকা। ২০২২-২১ অর্থবছরে ৫ কোটি টাকায় দুই হাজার ৮৫০ জনকে পুনর্বাসন করা হয়। ঢাকা থেকে আটক করা ভিক্ষুকদের জন্য পাঁচটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ১৬টি টিনশেড ডরমেটরি ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৪টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি দুটির কাজ চলছে বলে জানিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। 

সূত্র জানায়, ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকাসমূহে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৪১টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ২ হাজার ৬৫০ জন ভিক্ষুককে আটক করা হয়। আটক ২ হাজার ১২৫ জনকে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন মেয়াদে আটক রেখে প্রশিক্ষণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা হয়। অবশিষ্ট ৫২৫ জনকে পরিবারে পুনর্বাসন করা হয়। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ১৪১টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ২৮৮৬ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৮৬ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কিংবা জীবিকার জন্য উপকরণ কিনে দিলেও তা বিক্রি করে তারা ফের ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরে আসে। এ ছাড়া ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চক্র। এরা ভিক্ষাকে বাণিজ্যের অনুষঙ্গ বানিয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান থেকে ভিক্ষুকদের আটক করা হলে এই চক্রের সদস্যরা তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে ফের ভিক্ষায় নামিয়ে দেয়। ভিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ এসব চক্রের পকেটে চলে যায়।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভিক্ষুক, চা-শ্রমিক ও হিজড়া) মো. শাহ জাহান রূপালী প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখন ঢাকায় ঠিক কতজন ভিক্ষুক আছে, আমাদের কাছে তার হিসাব নেই। সাম্প্রতিককালে জুলাই আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে মোবাইলকোর্ট বন্ধ ছিল, যে কারণে ভিক্ষুকদের উপদ্রব বেড়েছে। খুব দ্রুতই এই অভিযান শুরু হবে।’ 

ভিক্ষুকেরা স্বভাবগতভাবেই পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতি বছর ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে সরকারের একটা বাজেট বরাদ্দ থাকে। বরাদ্দ অর্থ উপজেলার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বণ্টন করা হয়। ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য তাদের রিকশা-ভ্যান কিনে দেওয়া, দোকান করে দেওয়াসহ তারা যাতে কাজ করে, সেই ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু একসময় তারা সেটা না করে আবার ভিক্ষা পেশায় ফিরে আসে।

আরবি/জেডআর

Link copied!