অর্থ পাচার ঠেকানোর দায়িত্ব বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)। কিন্তু ঠেকাতে তো পারেইনি, উল্টো সংস্থাটির সাবেক প্রধান নিজেও অর্থ পাচার করেছেন। অর্থ পাচারে দেশের প্রভাবশালী কয়েকটি গ্রুপকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। নিয়েছেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, নিজের নামের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ ২৪টি বড় গ্রুপের ৯২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সংঘটিত মুদ্রা পাচারের ঘটনায় ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) বিএফআইইউর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়নি।
এছাড়া ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ইভেন্ট আয়োজন ও বিদেশ সফরের মাধ্যমে অর্থ অপব্যয় করেছেন। অবশেষে গতকাল শনিবার সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহযোগিতায় রাজধানীর মিরপুর-১০-এর সেনপাড়ার বাসা থেকে মাসুদ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিন তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুমা রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ ও অর্থ পাচারের অভিযোগ পাওয়ার পর গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের কথা জানায় দুদক।
অভিযোগ তদন্তে সংস্থাটির উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানকে দলনেতা করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২ জানুয়ারি মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, মাসুদ বিশ্বাস তার নিজ নামে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ৬২২ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করে তা নিজে ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
এজন্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় মামলা রুজু করা হয়। এছাড়া মাসুদ বিশ্বাসের স্ত্রী কামরুন নাহারের নিজ নামে ৭২ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(১) ধারায় পৃথক সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারির অনুমোদন দেওয়া হয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় এই দম্পতির নামে জমি ও ফ্ল্যাট রয়েছে, যাচাইকালে তা খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে দুদক।
অর্থ পাচার ঠেকাতে ২০০২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ‘এন্টি মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্ট বা এএমএল’ নামে একটি বিভাগ গঠিত হয়। পরে অধিকতর কাজের উদ্দেশ্যে ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে গঠন করে বিএফআইইউ। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি অর্থ পাচার ঠেকাতে তেমন কোনো দক্ষতা দেখাতে পারেনি।
উলটো অনিয়মের অভিযোগ ওঠে খোদ সংস্থাটির সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টদের মতে, রক্ষক হয়ে তিনি ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। এক কথায় বলা যায়, অর্থ পাচারের সব কটি দরজা তিনি তার মতো করে খোলা রেখেছিলেন।
বলা যায়, চোখ বন্ধ ছিল বিএফআইইউর। ফলে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে যায়। বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের থেকে ঘুষের মাধ্যমে অনিয়মে সহায়তা করেছেন। সহায়তা করেছেন অর্থ পাচারেও।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা একটি লিখিত অভিযোগ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের কাছে।
এতে বলা হয়, ২৪টি বড় কেসে (হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ অন্যান্য) ৯২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সংঘটিত মুদ্রা পাচারের ঘটনায় ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) বিএফআইইউর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়নি।
এছাড়া ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ইভেন্ট আয়োজন এবং বিদেশ সফরের মাধ্যমে অর্থের অপব্যয় করেছেন। গত কয়েক বছর বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বছরে গড়ে ৮-১০টির মতো বড় তদন্ত দায়সারাভাবে করে সেসব পক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এক্ষেত্রে গত কয়েক বছরের শতাধিক তদন্ত কেসকে পুনঃতদন্তের দাবি জানানো হয়। সব মিলিয়ে এসব অনিয়মের কারণে বিএফআইইউ ক্রমেই একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় অভিযোগপত্রে।
এতে আরও বলা হয়, বিএফআইইউর প্রধান চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ও আবদুল কাদির মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে অবহিত থেকেও পাচার ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
এমনকি জিনাত এন্টারপ্রাইজের পাচারের কেসে ৫০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে কেসটি ধামাচাপা দিয়েছেন। পাশাপাশি ইউসিবি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে থার্মেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মঞ্জুরিকৃত ঋণের অর্থ ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করার গুরুতর অনিয়ম বিএফআইইউর তদন্তে ধরা পড়লেও এ বিষয়ে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
এছাড়া একটি বেসরকারি ব্যাংকের অবজারভার থাকা অবস্থায় ওই ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন মাসুদ বিশ্বাস।
রূপালী ব্যাংকের গ্রাহক ডলি কনস্ট্রাকশনের অনুকূলে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করে ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। বিষয়টি বিএফআইইউর তদন্তে ধরা পড়লেও মাসুদ বিশ্বাস ঘুস গ্রহণের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি।
পাশাপাশি ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক সান্ত্বনা এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংকটির চারটি শাখা থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিতরণ করে। মাসুদ বিশ্বাস শাখা ব্যবস্থাপকদের থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
এছাড়া সাদ-মুসা গ্রুপ একাধিক ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার গৃহীত ঋণের অনিয়ম যাচাইকালে বিভিন্ন ব্যাংকের গাফিলতি, দুর্নীতি ও অনিয়মাদি উদ্ঘাটিত হলেও তিনি দাপ্তরিক ক্ষমতাবলে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রাহক সাজিদা ফাউন্ডেশনের চুয়া ডেবিট ইনস্ট্রাকশনের বিপরীতে ২০২১ সালে ৮২ হাজার ৪১৬ ডলার আইএনজি ব্যাংক এলের গ্রাহক এফএমও এনভি আইএনএল এমএএসএসআইএফের অনুকূলে পাঠানোর মাধ্যমে পাচার করে।
মাসুদ বিশ্বাস ব্যাংকটির কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে অনিয়মটি ধামাচাপা দিয়েছেন। এছাড়া যমুনা ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার গ্রাহক শিরিন স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ১০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠানো এবং এনআরবিসি ব্যাংকের গ্রাহক বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানি টাইগার আইটির নামে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদানে অনুমোদনের জন্য মাসুদ বিশ্বাস অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করেন।
এছাড়া তিনি মার্কেট সিস্টেমস ও নগদের আর্থিক কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে ইতালিতে বিদেশ সফরের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ গ্রহণ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, যে প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচার ঠেকাবে, সেই প্রতিষ্ঠান যদি অর্থ পাচারে সহায়তা দিয়ে থাকে, তাহলে তো কিছু বলার নেই। এটা অনেক ভয়ংকর ব্যাপার।
এর জন্য শুধু গ্রেফতার নয়, এসব অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী যেই হোক, তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে বিএফআইইউকে পুরোপুরি সংস্কার করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সম্পদের তথ্য জানতে ১১ দেশে চিঠি দেয় দুদক
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের সম্পদের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ১১ দেশে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
একই সঙ্গে তিনি যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠিও পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষগ্রহণ, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎপূর্বক কোটি কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
গত ৪ অক্টোবর দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের সই করা পৃথক চিঠি দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, অর্থ পাচার ঠেকাতে ২০০২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ‘এন্টি মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্ট বা এএমএল’ নামে একটি বিভাগ গঠিত হয়।
পরে অধিকতর কাজের উদ্দেশ্যে ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে গঠিত হয় বিএফআইইউ। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি অর্থ পাচার ঠেকাতে তেমন কোনো দক্ষতা দেখাতে পারেনি। উলটো অনিয়মের অভিযোগ ওঠে খোদ সংস্থাটির সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে।
আপনার মতামত লিখুন :