ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪
জিরো টলারেন্স মানছেন না

অপরাধে জড়াচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৪, ০৬:০১ পিএম

অপরাধে জড়াচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের একটি অংশ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের গত দুই মাসের কর্মকাণ্ড ১৭ বছর ধরে বিভিন্ন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার দলটিকে সমালোচনার জায়গায় নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে দলের শীর্ষপর্যায় থেকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও কার্যত কোনো সুফল মেলেনি। বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনা অমান্য করে সারা দেশে বিশৃঙ্খলা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের বহু নেতাকর্মী। যদিও এসব বিষয়ে খুবই কঠোর অবস্থানে থাকতে দেখা যাচ্ছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। যখনই কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এখন পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে বিএনপিতে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর হামলা, দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, দলীয় নির্দেশনা অমান্য করাসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গত দুই মাসে হাজারের বেশি নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে বহিষ্কার, অব্যাহতি, পদাবনতি ও কমিটি বাতিল করার মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরও অভিযোগ আসা এখনো থামেনি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চাঁদাবাজি, দখল, হিন্দুদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও দখল, বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার অভিযোগেসহ দলের নীতি ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সারা দেশে বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সূত্র বলছে, চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং নিজেদের মধ্যে খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে এই তিন সংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কোনো কোনো নেতাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে মামলাও করা হয়েছে। যেমন চাঁদাবাজিসহ দলের সুনাম ক্ষুণ্ন করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে রাজধানীর কলাবাগান থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক (বহিষ্কৃত) ওবায়দুল ইসলাম সৈকতের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

রাজধানীর হাতিরঝিলে দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিম হত্যার অভিযোগে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবির সাংগঠনিক পদ স্থগিত করেছে বিএনপি। এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে তাকে। গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছে, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রবির সব সাংগঠনিক পদ স্থগিত থাকবে। এর আগে গত ১১ অক্টোবর রবিকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। পরে শেখ রবি যে জবাব দিয়েছেন, তা সন্তোষজনক না হওয়ায় তার সব সাংগঠনিক পদ স্থগিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই হত্যা মামলায় ৩ নম্বর আসামি শেখ রবিউল আলম রবি পলাতক আছেন।

দলটির দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৩ জন নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫২৩ জনকে কারণ দর্শানোর নেটিশ, ৪৩৭ জনকে বহিষ্কার, ২৪ জনের পদ স্থগিত, ৩৫ জনকে সতর্ক এবং ৪ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, দলটির কেন্দ্রীয় প্রায় ১৫ জনের মতো নেতার বিরুদ্ধে দলের নীতি-আদর্শ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এসেছে, তাদের পদ স্থগিত করা হয়েছে। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অপেক্ষাকৃত হালকা, তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে বিতর্কিত ব্যবসায়ীর গাড়ি ব্যবহার এবং যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের বিরুদ্ধে আরেক বিতর্কিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগারওয়ালার সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুই জনকে শোকজ করা হয়।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাহবুব উদ্দিন খোকন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সেলিম রেজা হাবিবের বিরুদ্ধে দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে গণমাধ্যমকে হুমকি দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে শোকজের পাশাপাশি পদাবনতি দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামের (বাবুল) অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং এক কর্মী খুনের ঘটনায় এ দুই নেতার দলীয় পদ স্থগিত করা হয়। যদিও শামা ওবায়েদকে নিয়মিত দলের কূটনৈতিক বৈঠকে অংশ নিতে দেখা যায়। পদ স্থগিত হওয়ার পর কেন এবং কীভাবে তিনি বৈঠকে অংশ নিচ্ছেনÑ এ নিয়ে বিএনপির একটা অংশের অসন্তোষ রয়েছে। দখলবাজির অভিযোগে বিএনপির আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল হক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইফুল আলম নীরবÑ এ দুই নেতার নেতৃত্বে আড়াই মাস আগে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির কমিটি দেওয়া হয়। কিন্তু নীরবের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি আর আমিনুল হকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নির্বাচনে দলের আরেক নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ ওঠে, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নেতৃত্বাধীন মহানগর উত্তর কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।

ঝুট ব্যবসার কাজ নিজ দলের নেতাকর্মীদের পাইয়ে দিতে সুপারিশের অভিযোগে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা ও ভালুকা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিএনপির নাম ব্যবহার করে এ কাজের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয় দলের পক্ষ থেকে।

বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের বিলাসবহুল গাড়ি সরানোর ঘটনার অভিযোগ উঠলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও কর্ণফুলী বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়াকে শোকজ করা হয়। কিন্তু শোকজের জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়া ওই কমিটি বিলুপ্ত করে দেয় বিএনপি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে দখল, চাঁদাবাজি কিংবা বিভিন্ন স্থানীয় ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিএনপির একশ্রেণির অসাধু নেতার বিরুদ্ধে। দল তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে অভিযোগের মাত্রা কমে আসছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় বিএনপিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের অভিযোগ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। না হলে তার প্রভাব পড়বে ভোটে। একটি রাজনৈতিক দল, যারা একসময় বিএনপির জোটে ছিল, তারা নিজেরাও দখলের অভিযোগ এনে ভোটে নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তারা যেন এই সুযোগ নিতে না পারে, তার জন্য অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিএনপিকে এখন থেকে আরও শক্ত অবস্থানে যেতে হবে বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতা।

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শেরপুরে সংঘর্ষে ছাত্রদলের জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম শ্রাবণ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ সেপ্টেম্বর মারা যান। তার আগে ৬ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন কালীগঞ্জের মোক্তারপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি এমদাদুল হক (৬০)। ২১ আগস্ট ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় কবির ভুঁইয়া (৫৫) নামে একজন নিহত হন।

এ ছাড়া বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে গত কয়েক দিনে চাঁদপুরে কমপক্ষে ৫০ জন, নওগাঁয় কমপক্ষে ২০ জন, জামালপুরে কমপক্ষে ৩০ জন, কুষ্টিয়ায় কমপক্ষে ১০ জন, কুমিল্লায় কমপক্ষে ৫ জন, নীলফামারীতে কমপক্ষে ১০ জন এবং গাজীপুরে কমপক্ষে ১০ আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দলীয় নীতি ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও মামলা পর্যন্ত করা হয়েছে। আগামীতেও এটি অব্যাহত থাকবে।’

দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, সেটা আমি জানি না। তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে যথাযথ তদন্ত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের অনিয়ম অপরাধ ও দখলদারির সঙ্গে জড়িত থাকলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যত বড় নেতাই হোক, অপকর্মে লিপ্ত হলে কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি। অপরাধের অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রথমে তাকে শোকজ করা হচ্ছে। তারপর পদ স্থগিত কিংবা বহিষ্কারের ঘটনা আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। বিএনপির জিরো টলারেন্স নীতিতে আছে অপরাধের বিষয়ে। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কোনো রকমের দখল কিংবা অপরাধে জড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএনপি।

আরবি/এফআই

Link copied!