দ্রুত সময়ে নির্বাচন আদায়ে সরকারের ওপর কৌশলে চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপি। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির ১৬ বছর কেটেছে রাজপথে আন্দোলন করে। ফলে দ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি। এদিকে রাষ্ট্র সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সব দিক থেকে নির্বাচনের জন্য বাড়ছে চাপ। সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চায় দলটি।
কারণ, সরকারের সংস্কার ধীরগতি বলে মনে করছে তারা। সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দলও একই দাবি জানাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী সংস্কারে গুরুত্ব দিলেও বিলম্বিত নির্বাচন চায় না।
গত রোববার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির নীতিনীর্ধারণী ফোরামের নেতা মির্জা আব্বাস বলেছেন, এত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেবে না অন্তর্বর্তী সরকার। তার ধারণা, আওয়ামী লীগ যত দিন পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে আসার সুযোগ না পাবে, তত দিন নির্বাচন দেবে না বর্তমান সরকার। এ নিয়ে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।
বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলছে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারের সংস্কার উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিএনপি মনে করে, শুধু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারই যথেষ্ট। দলটি বলছে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে অন্য সংস্কারগুলো করা সম্ভব হবে। আর সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না দলটি। বিএনপি মনে করে, গত ১৬ বছরে গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলেছে ফ্যাসিবাদী সরকার। সাংবিধানিক বিধান এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে সাবধানতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে পরামর্শও দিয়েছে বিএনপি। এই অবস্থান থেকেই দলটি রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে এবং দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে বলে জানান বিএনপির নেতারা। বিএনপির মহাসচিব ইতিমতো বলেই দিয়েছেন, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার আমরা কারা। কোন রাজনৈদিক দল নিষিদ্ধ হবে তা ঠিক করবে দেশের জনগণ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকার সংস্কার চায়। আমরাও চাই। তাই বলে অনন্তকাল তো তাদের সময় দেওয়া ঠিক হবে না। দেশের মানুষ তাদের ভোটের অধিকার ফেরত চায়। যা হরণ করে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দ্রুত ভোটের নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন সরকারের। তাদের কাজে ধীরগতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। জনগণের চাপ রয়েছে আমাদের ওপর। আমাদের ওপর যত চাপ বাড়ছে, আমরাও নির্বাচনের জন্য চাপে রাখার চেষ্টা করব সরকারকে। কবে থেকে সেই চাপ সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি সেটি কেউ স্পষ্ট না করলেও বিএনপির একটি সূত্র বলছে, বিএনপির বিভাগীর সমাবেশ শেষ হবে ডিসেম্বরে। সমাবেশ শেষে সরকারের ওপর কৌশলে চাপ বাড়াবে বিএনপি। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিষয়ে বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
দলটির অনেক নেতা বলেছেন, এতে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে এবং নির্বাচন বিলম্বিত হবে। বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও আস্থা সৃষ্টি হবে।
ইতিমধ্যে সার্চ কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে নাম চেয়েছে সার্চ কমিটি। গত রোববার সুপ্রিম কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম বৈঠক। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আগামী ৭ নভেম্বরের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নাম দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে একক কোনো দল, সংগঠন বা ব্যক্তির সর্বোচ্চ পাঁচটি নাম প্রস্তাব করার সুযোগ থাকবে।
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার চাপের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার এমন আশ্বাস তৈরির পদক্ষেপ হিসেবে গত মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য দুই বিচারপতির সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি করেছে। একই দিন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, সরকার নির্বাচনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যেই কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। এরপর রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে সবার পরামর্শের ভিত্তিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবে সরকার।
বিএনপি শুরু থেকেই সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলে আসছে। তবে জামায়াতের অবস্থান কিছুটা ভিন্ন, দলটি সংস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কবে নাগাদ নির্বাচন হতে পারে সে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আভাস দেওয়া হয়নি।
সেপ্টেম্বরের শেষদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সেনাবাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে। আইন উপদেষ্টা আফিস নজরুলও আগামী বছর নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।
যদিও বিএনপি চায়, আগামী বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এরই মধ্যে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করে যাচ্ছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পৃথক এসব বৈঠকে সমমনা দলগুলোর নেতারাও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত হয়েছেন। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার পরামর্শ তাদের। দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা ও নির্বাচন সম্পর্কিত সংস্কার সম্পন্ন করার মাধ্যমে সরকার জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে সংকট গভীর হবে।
বিএনপির সমমনা দলগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করেন বিএনপির সমমনা দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবে সরকার, এমনটাই প্রত্যাশা করছি। ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। তবে এর আগে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকা কিছু দলও দ্রুত নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টার বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
তিনি বলেন, ‘আশা করছি সরকারের কথা ও কাজের মিল থাকবে। প্রত্যাশা থাকবে নির্বাচন কমিশন গঠনের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।’
সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ দিক থেকে বিএনপির সঙ্গে দলটির অবস্থানের কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। জামায়াত যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে। তবে বিলম্বিত নির্বাচন চায় না।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরাও নির্বাচন চাই। গত ১৫ বছর জনগণ ভোট দিতে পারেনি। সামনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। আমরা সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছি, কিন্তু তাই বলে নির্বাচন বিলম্বিত হোক, তা আমরা চাই না।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা এখন ৭ নভেম্বরের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। সারা দেশে আমাদের সমাবেশ চলছে। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) যশোরে বিএনপির সমাবেশ আছে, সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করছি। আমরা আশা করব, সরকারও আমাদের সহযোগিতা করবে। তবে তাদের মনে কী আছে সেটা তো আমরা জানি না। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আমরা। আমাদের বাদ দিয়ে কিছু করার চিন্তা যাতে কেউ না করে। আমাদের কর্মীরা গত ১৬ বছর জেল-জুলুম ও হুলিয়া মাথায় নিয়ে রাজপথে ছিল। আমরা ইন্টেরিম গভর্নমেন্টকে সময় দিয়েছি, আরো সময় দেব। তাই বলে যত দিন তারা চাইবে তা তো না। আমার চাই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে সরকার।
আপনার মতামত লিখুন :