বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরমে। দুই দলের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। দেশের রাজনীতিতে দুই দলের হাত ধরাধরি চলার ইতিহাস ৪৭ বছরের পুরোনো। ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক প্রায় দুই যুগের। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে এ সম্পর্ক টিকে ছিল। টানা ১৬ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনীতির মাঠে সাবেক ক্ষমতাসীন দলটির দৃশ্যত কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এই সুযোগে রাজনীতির ফাঁকা মাঠে নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে হাজির করতে চাইছে জামায়াত। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিএনপিকে এড়িয়ে নানা ইস্যুতে অবস্থান নিতে দেখা গেছে দলটিকে।
দিন যত যাচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব তত বাড়ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তার বলছেন, বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গে দূরত্বের কথা চিন্তা করে অন্যান্য দল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একসময়ের বিএনপির অন্যতম মিত্রদল, একাধিকবার জোট করে ভোট করা জামায়াত-বিএনপির দ্বন্দ্ব এখন অনেকটা স্পষ্ট। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। শীর্ষ নেতারা একে অপরের প্রতি করছেন কটাক্ষ। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল দুটির অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় তা দেখার বিষয়।
তাদের দাবি মূলত, ৫ আগস্টের পর থেকেই জামায়াতে সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এর কারণ, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় আগামী সংসদ নির্বাচনে দুদলই এ সুযোগ কজে লাগাতে চাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত এবং ছাত্রদল-শিবিরের সঙ্গে একাধিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
জামায়াত চায় সংস্কার, বিএনপি চায় নির্বাচন: একাধিক রাজনৈতিক দলের সূত্র জানায়, বিশেষ করে জামায়াত এখন চাচ্ছে, সব সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচন হবে। আর বিএনপি চাচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই নির্বাচন জরুরি। এদিকে আগামী নির্বাচনে জামায়াত এককভাবে ৩শ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা করলেও এর কয়েকদিন পর এসব বিষয়ে কয়েকটি ইসলামি দল নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বিএনপিও নির্বাচনকে সামনে রেখে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে যাচ্ছে। সঙ্গে নেই জামায়াত। সব মিলিয়ে দল দুটির দূরত্ব এখন অনেকটাই দৃশ্যমান দেখা গেছে।
বিএনপি মোনাফেক: জামায়াত: সম্প্রতি বিএনপির একটি প্রোগ্রামে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দিলে জামায়াতও এর কড়া প্রতিবাদ জানান। রিজভী তার বক্তব্যে জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বলেন, এরা ব্যাংক দখলসহ অনেক দখলদারিত্বে জড়িত। রিজভী অভিযোগ করে বলেন, একটি দল এখন বড় বড় কথা বলে বিএনপির নামে কলঙ্ক লেপন করছে। পাড়া মহল্লায় টার্মিনাল দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা কিছু দখল করেছে একটি দল। ৫ আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ দেখেছে জনগণ। কারা পায়ের রগ কাটে তাদের চিনে জনগণ। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে একাত্তরের বিরোধিতাকারী জামায়াত। রিজভীর এ বক্তব্যে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। বিবৃতিতে বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে গত রোববার রাতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বিএনপিকে মোনাফেক আখ্যা দিয়ে বলেন, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্ন মতের লোকদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য করা হয়েছিল তা কী জাতির সঙ্গে মোনাফেকি নয়? তিনি বলেন, কারা দলীয় টিম নিয়ে ভারত সফর করে ভারতের সঙ্গে সখ্য করার চেষ্টা করেছেন, তা জনগণ ভালো করেই জানে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের এই দূরত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পারওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আমাদের যা বলার বলে দিয়েছি। আমরা অফিসিয়ালি বিষয়টি দেশের মানুষকে জানিয়েছি। আপাতত এরচেয়ে বেশি কিছুই আর বলার নেই। তবে, এ বিষয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, বিএনপি আমাদের সময় যে অভিযোগগুলো করছে তা সঠিক কি না বুঝতে হবে। জামায়াত তো বিএনপির বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। ৫ আগস্টের পর থেকে দখলবাজি করেছে বিএনপি। তাদের চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই অপরাধে অনেক নেতাকর্মীকে বহিষ্কারও করেছেন। রিজভী জামায়াত নিয়ে গুরুতর মিথ্যাচার করেছেন। মতিউর রহমান আকন্দের অভিযোগের জবাবে রিজভী বলেছেন, ‘জামায়াত ব্যাংক দখল করেছে’। সত্যি হলো ব্যাংক দখল করেছিল এস এম আলম। আর ব্যাংকের উচ্চ পরিষদের কমিটি গঠন করেছে। স্বাধীনতা বিরোধিতা করা, মোনাফেক, রগকাটাসহ অনেক তকমা দিয়েছেন যা জামায়াত করে না। এর আগেও বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে।
তবে জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতারা জানান, মাঠে অনেক রাজনৈতিক কথা হয় বা হয়ে থাকে। তা ছাড়া এসবে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি না করাই ভালো বলে মনে করেন তারা। তাদের দাবি, দরকার হলে জামায়াত বিএনপি দুই দল সংস্কার চায়। তবে এখন তারা বিএনপির সঙ্গে কোনো জোটভুক্ত নয়। জামায়াতের দলীয় একটি সূত্র জানায়, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের সব সময় কঠোর যোগাযোগ আছে। তারা ইসলামি দল ও সংগঠনের সঙ্গে এখন আলাপ-আলোচনা করছেন দেশের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
অন্যদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল বেশকিছু নেতারা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আপাতত তারা এখন এককভাবে চলতে চান। কারণ, এখন দেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করবেন কি না, সেটা পরের সিদ্ধান্ত। সামনে এখনো রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ রয়েছে।
বিএনপিকে মোনাফেক বলা প্রসঙ্গে: বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, জামায়াত যদি বিএনপিকে মোনাফেক বলে তাহলে ১৮ সালেও তারা (জামায়াত) ধানের শীষ প্রতীক নির্বাচন করল কীভাবে! তাদের এই মিথ্যাচারের ব্যাখার প্রয়োজন নেই। এই জামায়াত ২৪-এর গণহত্যার ১ সপ্তাহের মধ্যে পতিত স্বৈরশাসককে মাফ করে দিয়েছিল। শহীদদের রক্তের দাগ না শোকাতেই তারা আপস করতে চেয়েছিল। তারা শুধু স্বাধীনতাবিরোধীই ছিল না, পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিল। এরা এখনো এসব কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তিনি বলেন, এ ছাড়াও বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করার কারণেই জামায়াত ১৮ থেকে ২০টি আসন পায়, আর একক নির্বাচন করলে পায় ৩ থেকে চারটি আসন। আসলে জামায়াতই জামায়াতের জন্য ভয়ঙ্কর যার দায়ভার বিএনপির ওপর দিতে চাইছে। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে জামায়াতের যেহেতু একটি ক্ষত রয়েছে, সে হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা উচিত ছিল। কূটকৌশল করে স্থায়ী কিছু পাওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, এই জামায়াতকে কাছে রাখার অপরাধে বিএনপিকেও অনেক কাফফারা দিতে হয়েছে। দেশ-বিদেশে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে।
আমাদের সঙ্গে রাজপথে ছিল, ক্ষমতায় আসার পরও আমরা জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদারত্ব করেছিলাম। বিএনপি অকৃতজ্ঞ দল নয়। একেক সময় একেক বন্ধু তৈরি করা বিশ্বস্ততার কাজ নয়।
বিএনপি-জামায়াতের প্রকাশ্যে বিরোধ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে জানি না। স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না হলে কোনো কিছু বলা সঠিক হবে না।’
বিএনপি এবং জামায়াতের বর্তমান সম্পর্ক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশের ভোট মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় জামায়াত সেই ফাঁকা জায়গায় একটি শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রকাশ করতে চাইছে। এ কারণেই তারা এখন বিএনপির বাইরে গিয়ে অবস্থান নিতে চাচ্ছেন হয়তো। তবে নির্বাচন দেরিতে হলে তাদের শক্তি আরও সংহত হতে পারে। তবে এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ, তাদের যে ভোট ব্যাংক, তা খুব বেশি বাড়বে না।
কারণ, নির্বাচন দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগ অল্পকিছু আসন পেতে পারে। কিন্তু তারা অনেক ভোট পাবে এটা আশা করার কোনো কারণ নেই। আর জামায়াত যদি ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করে, তাহলে তাদের আসন কিছু বাড়বে। তিনি আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন দল গঠন করলে তার প্রভাব ভোটের রাজনীতিতে পড়বে না। তবে তাদেরকে মানুষ স্বাগত জানাবে। প্রভাব না পড়ার কারণ হলো, বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতি অন্য রকম এবং আলাদা।
আপনার মতামত লিখুন :