ফ্যাসিবাদ পতনের পর দেশ চলছে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। তিন মাস পার করেছে এই সরকার। দেশের মানুষ বর্তমান সরকারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনমুখী। কবে হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাই নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপ হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা এখন নির্বাচন নিয়ে।
নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাইলেও সেটার দৈর্ঘ্য কত হবে তা নিয়েও চলছে আলোচনা। এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এই সরকার এত সহজে নির্বাচন দেবে না।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই সরকার ১০-২০ বছর থাকতে চায়। অন্যদিকে জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উসখুস করছে রাজনৈতিক দলগুলো। উপদেষ্টার মন্তব্যের বিপরীতে মির্জা ফখরুল বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই রাজনীতি করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্যের ওপর দেশ, মানুষের ভাগ্য এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে মনে করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে বিএনপির পূর্ণ সমর্থন থাকবে বলে জানান তিনি। এদিকে নির্বাচন নিয়ে যৌক্তিক সময়কে টেনে লম্বা করলে মানুষের মধ্যে সন্দেহ হতাশা আর সংশয় তৈরি হবে বলে মনে করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করায় ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি।
বিএনপির সঙ্গে তখন ২১টি রাজনৈতিক দলের জোট থাকায় তারাও অংশ নেয়নি নির্বাচনে। সেই নির্বাচন বর্জন করে বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো। দলীয় সরকারের অধীনে গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করেনি পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমনটাই মনে করে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদ পতনের পর অন্তর্বর্তী যাত্রায় সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াত চেয়েছিল সংস্কার। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে দ্ইু দফা সংলাপও হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। নির্বাচন নিয়ে সরকার সময় ক্ষেপণ করছে বলেই মনে করছে বিএনপি। দ্রুত নির্বাচন না দিলে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ইন্টারিয়াম গভর্মেন্টের ওপর নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। জুলাই বিপ্লবের সাফল্য। এই সরকারের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক এমনটাই চায় বিএনপি।
অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। আমরা চাই সব দল নির্বাচনে যাবে সেখান থেকে যারা বিজয়ী হবে তাদের সবাইকে নিয়ে একটি ন্যাশনাল গভর্মেন্ট করব, সব দল নির্বাচনে আসলে সবাইকে নিয়ে সংস্কার করা এবং দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারব। একদলের ওপর সামগ্রিক সাফল্য নির্ভর করছে না। সবাইকে নিয়ে করলে সুন্দর একটি সরকার হবে। ন্যাশনাল গভর্মেন্ট করব আমরা। যদিও এর একটা সমস্যা আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কাকে নিয়ে করব ন্যাশনাল গভর্মেন্ট? এখন করলে আওয়ামী লীগকেও আনতে হবে, জাতীয় পার্টিকেও আনতে হবে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, এখন করলে যারা এখন নিবন্ধিত হয়েছেন তাদের হয়তো আনা যাবে না, তারা বাদ পড়ে যেতে পারে। যত দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন করবে, আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে তাদের ওপর।
জাতীয় সরকার না হলে বিএনপি সরকার গঠন করলে বিরোধী দলে কারা থাকবে এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ বলেছিল তারা সরকারে যাবে না। এখন তাদের অবস্থা কি ঠিক জানি না। তাদের অবস্থান বদলাতেও পারে। সেই ক্ষেত্রে যারা সরকারে যেতে চাইবে না তারা বিরোধী দল হতে পারে। জামায়াত কীভাবে নির্বাচন করবে তার ওপর নির্ভর করবে। তারা সরকারে থাকবে নাকি বিরোধী দলে যাবে সেটি সময় বলে দেবে।
আর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মনে করেন, সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ নাও হতে পারে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার চান তিনি।
তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ২০১৪, ২০১৮ এবং সবশেষ ২০২৪ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোটের অধিকার হরণ করেছিল। দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। বিগত সরকার সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। ধ্বংসের স্বীকৃতি হিসেবে নির্বাচন কমিশনারকেও বিদায় নিতে হয়েছে। এখনো নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়নি। গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তারা ঠিক করবে নির্বাচন কীভাবে হওয়া উচিত, কখনো হওয়া উচিত। জরুরিভিত্তিতে এখন কিছু সংস্কার হওয়া দরকার। কতটুকু হবে জানি না। সংস্কার নিয়ে জামায়াতের ৪১ দফা ছিল। আমরা কেটে ছেটে ১০ দফা প্রদান করেছি প্রধান উপদেষ্টার কাছে। যেগুলো সংস্কার হওয়া উচিত। এই সরকারকে এখন উদ্যোগ নিতে হবে। এই সংস্কার হলে আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভালো নির্বাচন হবে।
মানুষ তার পছন্দের দল এবং প্রার্থীকে বাছাই করে নিতে পারবে। সংস্কার আগে হবে না পরে হবে সেটা মুখ্য নয়; তবে সংস্কার হতে হবে অবশ্যই ইলেকশনের শিডিউল ঘোষণার আগে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে সংস্কার করতে হবে। কারণ শিডিউল ঘোষণা হয়ে গেলে সংস্থার আর এগোবে না। তখন নির্বাচনের প্রক্রিয়া হবে মূল বিষয়। আমরা এই সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই এটা ঠিক। সব রাজনৈতিক দল মনে করে, সরকারের যৌক্তিক সময় পাওয়া উচিত। তবে এই যৌক্তিক সময়ে এমন হওয়া উচিত নয় যে, এটাকে টেনে অনেক লম্বা করে ফেলবে। তাতে করে মানুষের মধ্যে হতাশা, সন্দেহ এবং সংশয় তৈরি হবে। আমরা আশা করব, বিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদ এটা বুঝতে ব্যর্থ হবে না। জনগণের আকাক্সক্ষা এবং সংস্কার দুটোই গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা বৈঠকে করেছে। সংস্কার এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া একসঙ্গে আগাবে আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি। ধরেন সংস্কার হলো, নির্বাচন হলো না তবে কী লাভ হবে? কিংবা নির্বাচন হলো সংস্কার হলো না, তাতে কি লাভ নেই।
নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি না হলে সেই নির্বাচনে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সেক্ষেত্রে অতীতের তিনটি নির্বাচনের মতো আরও একটা খারাপ নির্বাচন হতে পারে। জাতি বারবার পথ হারাতে চায় না। দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে দেশের গণতন্ত্র সুসংহত হবে বলে মনে করেন বিএনপি এবং জামায়াতের শীর্ষ নেতারা।
আপনার মতামত লিখুন :