ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে সময় বাঁচাতে ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে বিএনপি। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠন করা কমিশনে জমা দেওয়া প্রস্তাব তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আমরা যেসব প্রস্তাব করেছি, সেসব প্রস্তাব অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এখানে এমন কোনো প্রস্তাব করা হয় নাই যেটা নতুন করে কোনো কিছু করতে হবে। “আমরা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলেছি, নির্বাচন সচিবালয় করা এবং তাদের কিছু ক্ষমতা দেওয়া ইত্যাদি, আমরা প্রচলিত আইনগুলোর সংশোধন, সংস্কার, এগুলোর জন্য অধিক সময়ের প্রয়োজন হয় না।” অতি প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে আমাদের মনে হয় না খুব বেশি হলে ৩-৪ মাসের বেশি সময় লাগবে।” গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দাবি করেছিলেন। যদিও এরই মধ্যে পার হয়েছে ৪ মাস নির্বাচন নিয়ে খুব বেশিদূর এগোয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে বেশ তোপের মুখেই পড়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদুজ্জান আবার বলেছেন আগামী বছর হয়তো রাজনৈতিক সরকার দেখতে পাবে দেশের মানুষ। যদিও তার এই বক্তব্যকে ব্যক্তিগত বলে দাবি করেছে সরকারের অন্য একটি পক্ষ। নির্বাচন নিয়ে বেশ ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলা চলে। যদিও নির্বাচন নিয়ে বিএনপি যতটা আগ্রহ দেখাচ্ছে ঠিক ততটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না বাংলাদেশ জামায়েত ইসলামি কিংবা অন্যদলগুলো।
এদিকে বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে ভোটের জন্য সরকারের ওপর কৌশলে চাপ বাড়ানো হবে। এভাবে তো দীর্ঘদিন চলতে দিতে পারি না। নির্বাচিত সরকার না থাকায় একটার পর একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় সেটা তো আপনারা দেখতেই পারছেন।
ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার বিরোধিতা বিএনপির নির্বাচন সংস্কারবিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক মঈন খান বলেছেন, “যদি সত্যিকার অর্থে সৎভাবে সঠিক ভোটার তালিকা আমরা করতে চাই, তাহলে কিন্তু বাড়ি বাড়ি যাওয়া নয়, কম্পিউটার এআইর সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করা সম্ভব। সেটার জন্য বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাড়ি বাড়ি যাওয়া এটা অত্যন্ত ‘সময়সাপেক্ষ’ এবং ‘অপ্রয়োজনীয়’ এবং এটাতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যিনি মারা গেছেন তার নামটা অটোমেটিক্যালি বাদ চলে যাবে।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, “ভোটার তালিকা প্রণয়নে ‘বাড়ি বাড়ি যাওয়া’, আমরা এটা বুঝি নাই কী হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে, তালিকা ঘোষণার সময়ে এটাও ঘোষণা করা হয় যে, কারো নাম যুক্ত না হলে তাহলে তারা স্থানীয় নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে গিয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করবেন; বিভিন্ন কারণে ভোটার হওয়া যায়নি, এ রকম কেউ থাকলে কার্যালয়ে গিয়ে জানালেই তো ভোটার তালিকা হয়ে গেল, কারও নামে যদি অভিযোগ থাকে যে বেঁচে নাই, সেটা বাদ পড়ে যাবে। “এরপর নির্বাচনি প্রস্তুতি, শিডিউল ঘোষণা করা, রুল অনুযায়ী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করবে। এসব কিছু করতে এত বেশি সময় লাগার কথা না।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে বিএনপির কী প্রস্তাব গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন- আরপিও সংশোধনে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেওয়া সম্পূরক আদেশ বাতিল, নির্বাচন পরিচালনায় কিছু বিধিমালা সংশোধন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য আচরণবিধিমালা ও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নীতিমালা সংশোধন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা হালনাগাদ করা, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি, গণমাধ্যমের নির্বাচনি আচরণ বিধিমালাসহ ১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেন। এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো বিএনপি সরকারের গঠিত নির্বাচন সংস্কার বিষয়ে কমিশনের কাছে দিয়েছে বিএনপি। মঈন খান বলেছেন, “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য যাতে সত্যিকারভাবে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারে এবং জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে, ‘ডামি প্রতিনিধি’ না, ‘ভুয়া প্রতিনিধি’ না, সেজন্য আমাদের এই সংস্কার প্রস্তাব।”
আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে নির্বাচনকে ‘কুক্ষিগত করতে’ অনেক কিছু করেছে অভিযোগ এনে বিএনপি নেতা বলেন, “আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাতে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে না পারে, তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, সেজন্য আমরা ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের প্রণীত বিধিমালার সংশোধন চেয়েছি।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখি একটি রাজনৈতিক দল। দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ভোট দিতে পারে না। জনগণের জন্যই তো আমরা রাজনীতি করি। আমরা চাই দ্রুত সময়ে নির্বাচন। মানুষের চাওয়া কি অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চই তা বুঝবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান লড়াই আমরা করে যাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরেই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া অবধি আমাদের সংগ্রাম চলবে। আমরা আশা করব, দ্রুত সময়েই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে সরকার। এই সরকারকে চাপে রাখব, আন্দোলনের প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমি আগে থেকেই বলে আসছি আগামী এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়ে গেছে। নতুন বছরের ২ জানুয়ারি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। ভোটার তালিকা দ্রুত চূড়ান্ত করে ৩-৪ মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। যদি তাদের সদিচ্ছা থাকে। সব সংস্কার তো অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেও করতে পারবে না। সবকিছু সংস্কার করতে ১০ বছরেও সম্ভব নয়। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচিত সরকার ছাড়া সবকিছুর সংস্কার সম্ভব নয়। একটি মহল নির্বাচনে সময় ক্ষেপণ করতে চায়। তাতে করে তাদের কি খুব লাভ হবে, আমার মনে হয় এতে করে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। দ্রুত নির্বাচন হয়ে গেলে সবার জন্যই মঙ্গল।
আপনার মতামত লিখুন :