ঢাকা সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫

লাশ গুম করতে ফেলা হয় পদ্মায়

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৫, ১০:০৪ এএম

লাশ গুম করতে ফেলা হয় পদ্মায়

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

১৫ বছরের কিশোর কুতুব উদ্দিন পাপ্পু। রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা। গত ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি ছেলেটি। বাসায় না ফেরায়, তার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেন মা রুনা পারভীন রুনু। কিন্তু মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর বাড়ির এক ভাড়াটিয়ার ফেসবুক পেজে নিখোঁজ ছেলের ছবি আপলোড করে সন্ধান চান মা। 

পরের দিন ইমু নম্বরে পাপ্পুর শোয়া অবস্থায় চোখ বাঁধা একটি ছবি পাঠিয়ে দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। টাকা না দিলে পাপ্পুকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। পরে পাপ্পুর মা যাত্রাবাড়ী থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি অপহরণ মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তে পুলিশ জানতে পারে পাপ্পুকে হত্যা করা হয়েছে। 

পরবর্তীতে অপহরণ মামলাটি খুনের মামলায় রূপান্তর হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিবিড় তদন্তে বেরিয়ে আসে খুনিরা। গ্রেপ্তারও করা হয় আসামিদের কিন্তু এখনো পাপ্পুর লাশের সন্ধান মেলেনি। সাড়ে ৫ বছর ধরে ছেলের লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন বয়স্ক মা। 

আসামিদের জবানবন্দি ও মামলার নথিপত্র অনুসন্ধানে জান গেছে, পাপ্পুকে হত্যার পরে তার মাথা, হাত ও পা কাছাকাছি কুজো করে রশি দিয়ে বেঁধে একটি বইয়ের বস্তায় ভরা হয়। এরপর লাশ গুম করতে ভাড়া করা পিকআপে নিয়ে যাওয়া হয় মাওয়ায়। 

সেখান থেকে ট্রলারে করে বস্তাবন্দি পাপ্পুর লাশ ফেলে দেওয়া হয় প্রমত্তা পদ্মায়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাপ্পুর পরিচিত এলাকার বড় ভাই মো. রাজু ও রাজুর মামাতো ভাই শাহরিয়ার হোসেন নাদিম। তাদের কাছ থেকে পাপ্পুর মোবাইল ফোন ও পায়ের জুতা জব্দ করে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। 

জানা গেছে, পাপ্পু নিখোঁজ ও হত্যার রহস্য উন্মোচনে পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সম্প্রতি মামলাটির চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

 এতে রাজু (২৭) ও নাদিমকে (২৪) অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মো. রুবেল (৩১) ও আহ্সান উল্লাহ্ সুমনের (৩২) নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুই কোটি টাকা চাঁদা না পেয়ে পাপ্পুকে শ্বাসরোধে হত্যা করে রাজু।

 এরপর লাশ বস্তায় ভরে নাদিমের সহযোগিতায় মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার পাশে পদ্মা নদীর চরে নিয়ে যায়। লাশ পানিতে ফেলে পদ্মা নদীতে গোসল করে রাজু। এরপর ঘটনাটি কাউকে না বলার জন্য নাদিমকে হত্যার হুমকি দেয় রাজু।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ৩০৫ নম্বর শহীদ চান্দীর বাড়িতে থাকতেন রাজু। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা থানার সৈয়দকাঠি গ্রামে। রাজুর সঙ্গে এলাকার ছোট ভাই হিসেবে পাপ্পুর পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল। রাজু ও পাপ্পু মাঝে মধ্যে একসঙ্গে বিয়ার খেত।

 ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে পাপ্পুকে মদ পানের জন্য ডেকে নেয় রাজু। পাপ্পুকে রাজুর ভাড়াকৃত (২৩১ দক্ষিণ কুতুবখালী, যাত্রাবাড়ী) গোডাউনে নিয়ে যায়। সেখানে দুইজনে একত্রে মদপান করে। ইচ্ছা করে পাপ্পুকে অতিরিক্ত মদ পান করানো হয়। একসময়ে পাপ্পু অচেতন হয়ে পড়লে তার মুখ বেঁধে সেই ছবি পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দুই কোটি টাকার মুক্তিপণ দাবি করে রাজু। 

মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর নিজেকে বাঁচাতে লাশ গুমের পরিকল্পনা করে রাজু। সে অনুযায়ী, লাশ গোডাউনে রেখে এলাকার ভাঙারির দোকান থেকে ৫০ কেজি বই এবং ফলের আড়ত থেকে দুটি বড় সাদা রঙের প্লাস্টিকের বস্তা কিনে আনে। 

এরপর পাপ্পুর লাশ মাথা, হাত ও পা কাছাকাছি কুজো করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। গোডাউনে থাকা পলিথিন দিয়ে লাশ পেঁচানো হয়। তারপর বস্তার নিচে বই দেওয়া হয়। এর মধ্যে লাশ ঢুকিয়ে লাশের চারপাশে ফের বই দিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে ফেলা হয়। বাকি বইগুলো অন্য একটি বস্তায় ঢুকানো হয়। এরপর পাপ্পুর লাশ গোডাউনে রেখে রাজু বাসায় চলে যায়।

পরদিন সকালে গোডাউনে এসে রাজু তার খালাতো ভাই গাড়িচালক নাদিমকে ফোন দেয়। বলে, আমার কাছে চুরির বৈদ্যুতিক সরকারি মিটার আছে, সেগুলো ফেলার জন্য পিকআপ ভাড়া করতে হবে। নাদিম পিকআপ ভাড়া করে দেয়। 

নাদিম ও গাড়ির ড্রাইভার মিলে পিকআপে লাশ ও বইয়ের বস্তা উঠায় রাজু। লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মাওয়ার দিকে। আব্দুল্লাহপুর যাওয়ার পর পিকআপটি ছেড়ে দেওয়া হয়। নাদিমের সহায়তায় আরেকটি পিকআপ ভাড়া করা হয়। এরপর নতুন পিকআপ নিয়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ট্রলার ঘাটে যায় রাজু। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে একটি ট্রলার ভাড়া করা হয়। বস্তাগুলো ট্রলারে উঠানো হয়। ট্রলারে পিকআপ ড্রাইভার ইব্রাহিমকেও সঙ্গে নেওয়া হয়। পদ্মা নদীর অপর পাড়ের কাছাকাছি একটি চরে ট্রলার থামানো হয়।

ট্রলার ড্রাইভার, ইব্রাহিম ও নাদিমের সহায়তায় বস্তাগুলো নামায় রাজু। এরপর ট্রলার ড্রাইভারকে ভাড়া পরিশোধ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে পিকআপ চালককেও পাঠানো হয়। এরপর পদ্মার পানিতে নেমে লাশ ও বইয়ের বস্তা পানিতে ফেলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। 

এরপর রাজু পদ্মা নদীতে গোসল করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। পরে নাদিম ফোন করে আগের থেকে ঠিক করা সেই পিকআপ ড্রাইভারকে একটি ট্রলার নিয়ে আবার পদ্মার চরে আসতে বলে। পিকআপ ড্রাইভার ট্রলার নিয়ে আসলে ট্রলারে তারা লৌহজং ঘাটে ফেরত আসে। তারপর পিকআপ নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।

জানা গেছে, নদীতে বস্তাবন্দি পাপ্পুর লাশ ফেলে আসার পথে নাদিমকে লাশের বিষয়টি জানায় রাজু। এতে ভয় পেয়ে যায় নাদিম। রাজুর পরামর্শে সিলেট চলে যায় নাদিম। ঢাকায় এলে খুন করা হবে রাজুর এমন হুমকিতে নাদিম সিলেট দিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে মুদির দোকানে কাজ করে নাদিম। এরপর করোনা মহামারির সময় নাদিম দেশে ফিরে আসে। এরপর নাদিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, থানা পুলিশ, ডিবি হয়ে এই মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ)। পুলিশের ছয়জন কর্মকর্তা এই মামলার তদন্ত করেন। সবশেষ পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (দক্ষিণ) পরিদর্শক মো. শাজজাহান ভূঁঞা গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর আদালতে এই মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। এই মামলাটির আসামি ছিল অজ্ঞাত। 

দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবি করলে মামলার তদন্তে নতুন মোড় নেয়। এ ঘটনার সূত্র ধরে প্রধান আসামি রাজু ও তার খালাতো ভাই নাদিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

 এ ঘটনায় রুবেল ও সুমন নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও ঘটনার সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয়। পাপ্পু ধনাঢ্য থাকলেও রাজু ছিল মুদি দোকানদার। পাপ্পুকে জিম্মি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল রাজুর ধান্ধা।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, মামলার সার্বিক তদন্ত, গ্রেপ্তারকৃত রাজু ও নাদিমের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা, পাপ্পুর লাশ বহনকারী পিকআপের মালিক ও চালক, পাপ্পুর লাশ পদ্মা নদীতে ডুবানোর কাজে ব্যবহৃত ট্রলার চালকের জবানবন্দিসহ আদালতে দেওয়া সাক্ষীদের জবানবন্দি পর্যালোচনা, আসামি রাজুর কাছ থেকে জব্দকৃত মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জানা গেছে, পাপ্পুকে হত্যা করা, মুক্তিপণ দাবি এবং লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে পিকআপ ও ট্রলারযোগে পদ্মা নদীতে ডুবিয়ে দিয়ে লাশ গুম করার অপরাধ করে রাজু ও নাদিম।

কুতুব উদ্দিন পাপ্পুর মা রুনা পারভীন রুনু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সাড়ে ৫ বছর ধরে অপেক্ষায় আছি ছেলের লাশটা একটু দেখব বলে কিন্তু আজও ছেলের লাশটাকে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। আমার ছোট্ট ছেলেটাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ

রপর লাশ গুম করা হয়েছে। মদের বিষয়টি সাজানো হয়েছে। আমার ছেলে কখনো মদপান করত না। এগুলো আসামিদের সাজানো নাটক। আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!