ঢাকা বুধবার, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫

লাভে ফেরাতে বন্ড ইস্যু

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২৫, ০১:১৬ এএম

লাভে ফেরাতে বন্ড ইস্যু

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনকে (বিএসএফআইসি) লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে এবং ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি কমিয়ে আনতে ঋণের বিপরীতে ১০ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হবে। বন্ড ইস্যুর আগ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দেবে সরকার। বিএসএফআইসি ও এর অধীন চিনিকলগুলোর ঋণ পরিশোধের জন্য পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে এসব বন্ড দেওয়া হবে। 

ব্যাংক পাঁচটি হচ্ছে- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আফরোজা বেগম পারুল স্বাক্ষরিত এক চিঠির সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। চিঠির একটি অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।

চিঠি সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর সম্পূর্ণ বকেয়া ১ হাজার ৫১৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বিপরীতে মওকুফযোগ্য সুদ মওকুফ করে মওকুফোত্তর আদায়যোগ্য টাকা বিএসএফআইসির ট্রেডগ্যাপ ও ভর্তুকি বাবদ পাওনা টাকার সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হবে এবং ট্রেজারি বন্ড ইস্যুকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে প্রভিশনের সংরক্ষণ ও মূলধন ঘাটতি থেকে রক্ষার অংশ হিসেবে আগামী ডিসেম্বর-২০২৫ পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ইস্যু করা হবে।

২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসল ও সুদসহ বকেয়ার পরিমাণ সোনালী ব্যাংকের আসল বকেয়া ৩১০৫.৯২ কোটি টাকা, সুদসহ এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৩৩.৩৮ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের আসল বকেয়া ৮৯৪.৫০ কোটি টাকা। আর সুদসহ এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮৮৬.৫৮ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের আসল বকেয়া ৫২৬.৬৮ কোটি টাকা আর সুদসহ এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৭৬.৬৭ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের আসল বকেয়া ৬৮০ কোটি টাকা আর সুদসহ এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২০৭.৫৭ কোটি টাকা। কৃষি ব্যাংকের আসল বকেয়া ২০.৮৮ কোটি টাকা আর অনাদায়ীর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪.৬৮ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বিএসএফআইসির ঋণ হিসাবগুলো এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার মেয়াদও বাড়ানো হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই ঋণ ঋণগুলোর বিপরীতে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক বিপুল পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাবসহ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাংক সূত্র জানায়, বিপুল পরিমাণ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিং ও ক্যামেলস রেটিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়াসহ অতিরিক্ত এড নিশ্চিতকরণ চার্জ প্রয়োগের ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য হারে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উল্লেখ্য, এসব ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি এলসির প্রায় শতভাগ সম্পাদিত হয়ে থাকে। ফলে এর ব্যয়ভার পক্ষান্তরে সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিএসএফআইসি সূত্র বলছে, ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে বন্ড ইস্যুকরণের মাধ্যমে বিএসএফআইসিকে সহায়তা করা হলে সংস্থাটি তার চিনিকলগুলো চালু করে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্র বলেন, ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে দায় গ্রহণ একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মকাণ্ড বিধায় অন্তর্বর্তী সময়ে ঋণদায়গুলো আপাতত রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি প্রদান করা হলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো (চিনিকলগুলো) ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে এ খাতে ব্যাংকগুলো পুনঃবিনিয়োগেও আগ্রহী হবে।

ওই চিঠি সূত্রে আরও জানা গেছে, বিএসএফআইসি ও এর অধীন চিনিকলগুলোর অনুকূলে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এলটিআর, ওডি, সিসি (হাইপো.), ডিমান্ড লোন ও কৃষি ঋণ হিসাব দীর্ঘদিন যাবত পরিচালিত হয়ে আসছে। এ ঋণ হিসাবগুলোর বিপরীতে শুরুর দিকে নিয়মিতভাবে আসল ও সুদ পরিশোধ করা হলেও আর্থিক সংকটের কারণে সময়মতো ট্রেডগ্যাপ, ভর্তুকির টাকা না পাওয়ায় দীর্ঘদিন যাবত ঋণের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ সুদসহ চক্রবৃদ্ধি হারে যুক্ত হয়ে বছর বছর লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এত বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক অবস্থানে যেতে পারছে না।

এ বিষয়ে ইতোপূর্বে বিএসএফআইসির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাওনার বিপরীতে সুদ মওকুফ পূর্বক মওকুফযোগ্য সুদবিহীন ব্লক হিসেবে স্থানান্তর এবং মওকুফোত্তর আদায়যোগ্য পাওনা কস্ট অব ফান্ড হার/সহনীয় সুদ হারে পরিশোধের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়। ঋণের বকেয়া পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলো নিয়মিত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। 

বিএসএফআইসি সরাসরি আখ থেকে চিনি উৎপাদনকারী দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে বিএসএফআইসি ও এর অধীন চিনি কলগুলো দীর্ঘদিন যাবত ঋণ পরিচালিত হয়ে আসছে। এ ঋণ হিসাবগুলোর বিপরীতে শুরুর দিকে নিয়মিতভাবে আসল ও সুদ পরিশোধ করা হলেও আর্থিক সংকটের কারণে সময়মতো ট্রেডগ্যাপ, ভর্তুকির টাকা না পাওয়ায় দীর্ঘদিন যাবত ঋণের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অপরদিকে সরকারি চিনিকলগুলো কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যে যেমন আখ ক্রয় করে থাকে তেমনি ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রি করে থাকে। এতে বিক্রয় মূল্য অপেক্ষা উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় চিনিকলগুলো ক্রমাগতভাবে লোকসান বহন করছে। কিন্তু এ কার্যক্রমের ফলে দেশীয় চিনির বাজারে স্থিতিশীলতা রক্ষা সহজতর হচ্ছে। ফলে ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ সুদসহ চক্রবৃদ্ধি হারে যুক্ত হয়ে বছর বছর লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এত বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক অবস্থানে যেতে পারছে না।

জানা গেছে, ব্যাংক পাওনা পরিশোধের বিষয়ে ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএসএফআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সমন্বয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় একটি কমিটি গঠিত হয়।

সেই কমিটির সুপারিশ ছিল বিএসএফআইসির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক পাওনার বিপরীতে সুদ মওকুফ পূর্বক মওকুফযোগ্য সুদবিহীন ব্লক হিসেবে স্থানান্তর এবং মওকুফোত্তর আদায়যোগ্য পাওনা কস্ট অব ফান্ড হার/সহনীয় সুদ হারে পরিশোধের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা যেতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারি বন্ড ইস্যু করে যাবতীয় পাওনার বিপরীতে সুদ মওকুফের শর্তে অনাদায়ী ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিএসএফআইসির ট্রেডগ্যাপ ও ভর্তুকি বাবদ পাওনা টাকার বিপরীতে সরকারি বন্ড ইস্যু করা যেতে পারে। বিপিসি, বিজেএমসি ও ওরিয়ন গ্রুপের দায়-দেনা পরিশোধের জন্য একই রকম বন্ড ইস্যুর নজির অনুসরণ করা যেতে পারে।

আরবি/জেডআর

Link copied!