ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা (সিআরও) খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। শুধুমাত্র মশিউর সিকিউরিটিজ থেকে বিনিয়োগকারীদের ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তাকে শোকজ করা হয়েছে। তার দায়িত্বকালীন ধানমন্ডি, পিএফআই ও সিনহা সিকিউরিটিজে একই ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছে।
ঘটনায় আগামীকাল সোমবার খায়রুল বাশারকে বিএসইসিতে গিয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। ব্যর্থতার দায়ে খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছে নতুন কমিশন। কারণ দর্শনোর নোটিস সম্পর্কে জানতে খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদকে গতকাল শনিবার ফোন দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।
বিএসইসি সূত্র জানা গেছে, ধানমন্ডি সিকিউরিটিজের গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি পৌনে ৮ কোটি এবং পিএফআই সিকিউরিটিজের গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি রয়েছে ২৮ কোটি টাকা। মশিউর সিকিউরিটিজ থেকে বিনিয়োগকারীদের ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, খায়রুল বাশারের ব্যর্থতায় মশিউর সিকিউরিটিজ থেকে বিনিয়োগকারীদের ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রাহকের সমন্বিত হিসাবে ঘাটতি (সিসিএ) ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এছাড়া শেয়ার বিক্রি করে নিয়েছে ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে একক কোনো ব্রোকারেজ হাউজের এটিই সবচেয়ে বড় জালিয়াতি।
মশিউর সিকিউরিটিজের মতো ধানমন্ডি, পিএফআই সিকিউরিটিজ ও সিনহা সিকিউরিটিজে একই ধরনের জালিয়াতি হওয়ায় প্রতিষ্ঠান তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএসইসি।
খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রধান রেগুলেটরি কর্মকর্তা (সিআরও) হিসেবে ১২ জুন যোগদান করেন। যোগদানের পূর্বে এমটিবি ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ২০১৮-১৯ সাল মেয়াদে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খাইরুল বাশার।
নোটিস সম্পর্কে ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, খায়রুল বাশার মূলত সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন এবং ঝুঁকি এড়িয়ে বা অন্যদের কাঁধে ভর দিয়ে চলতে চান। তাকে আইনগত ক্ষমতা দেওয়া হলেও তার প্রয়োগ করতে ভয় পান। এসব কারণেই মশিউর সিকিউরিটিজে বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
সিনহা সিকিউরিটিজের পরিচালকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইওদের ব্যাংক হিসাব ও বিও হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণেও দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
১৮ সেপ্টেম্বর বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে ৯২১তম কমিশন সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, কনসোলিডেটেড কাস্টমারস অ্যাকাউন্টের ঘাটতি পূরণের জন্য সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সময় বৃদ্ধির আবেদন নামঞ্জুর করেছে বিএসইসি। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইও এর সকল ব্যাংক হিসাবের উত্তোলন বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠানো হবে।
পাশাপাশি ব্যক্তিদের সকল বিও হিসাব অবরুদ্ধকরণের জন্য সেন্ট্রাল ডিপজিটরী বাংলাদেশ লিমিটেডকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সিনহা সিকিউরিটিজের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইওর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার জন্য পুলিশের বিশেষ শাখা বরাবর অনুরোধ পত্র পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে কমিটি গঠন
মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একইসঙ্গে ‘ফ্রি লিমিট’ সুবিধা বন্ধ, পরিচালকদের ব্যাংক ও বিও হিসাব স্থগিত এবং জড়িত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তদন্তের পর আইন অনুসারে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানায় বিএসইসি।
ধানমন্ডি সিকিউরিটিজ ও পিএফআই সিকিউরিটিজ
২৯ আগস্ট গ্রাহক হিসাবে গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি পূরণের জন্য ধানমন্ডি ও পিএফআই সিকিউরিটিজ সময় বাড়ানোর আবেদন করে। কিন্তু কমিশন প্রতিষ্ঠান দুটির এই আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ব্রোকারেজ হাউস দুটির সব পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউকে চিঠি দেওয়া হয়। এ ছাড়া এসব ব্যক্তির বিও হিসাব জব্দে বিও হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউস দুটি পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইওরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, এ জন্য পুলিশের বিশেষ শাখাকে অনুরোধ জানানো হবে বলে জানিয়েছে বিএসইসি।
গত ২১ আগস্ট পর্যন্ত পিএফআই সিকিউরিটিজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি অর্থের পরিমাণ ছিল ২৮ কোটি টাকা আর ২০ আগস্ট পর্যন্ত ধানমন্ডি সিকিউরিটিজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি অর্থের পরিমাণ ছিল পৌনে ৮ কোটি টাকা।
পিএফআই সিকিউরিটিজের পরিচালক রয়েছেন মোট ১২ জন। তারা হলেন তারেক একরামুল হক, নাসিম ইকবাল, শাহরিয়ার খালেদ, কে এম রকিব হাসান, কাজী সালমান সারওয়ার, মোস্তাফিজুর রহমান, মনজুর আহমেদ, মোহাম্মদ জাভেদ লিয়াকত, মোহাম্মদ ফারুক, মোহাম্মদ ইয়ামিন কবির, মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান ও কাজী ফরিদউদ্দিন আহমেদ।
ধানমন্ডি সিকিউরিটিজের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন চারজন। তারা হলেন মিজানুর রহমান খান, আকতার জাহান খান, মেজবাহ উদ্দিন ও আসিফ ইসলাম খান।
বিএসইসির শোকজের চিঠি
খায়রুল বাশারকে দেওয়া শোকজের চিঠিতে বিএসইসি বলেছে, গত ১৪ মে মশিউর সিকিউরিটিজ পরিদর্শনে ডিএসইকে নির্দেশ দেয় বিএসইসি। যা শেষ করে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও দায়িত্বরত খায়রুল বাশার যথাসময়ে পরিদর্শন ও প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে খায়রুল বাশার কমিশনের নির্দেশনা এবং ডিএসই রেগুলেশনস, ২০১৩ এর রেগুলেশনস ১৬(১০)(বি) ও ১৬(৩)(এ) পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ধারা ৭ ধারা প্রয়োগের আগে খায়রুল বাশারের কাছে মশিউর সিকিউরিটিজে ব্যর্থতার বিষয়ে ব্যাখ্যা শুনতে চায় কমিশন। তাই তাকে ব্যাখ্যা করতে বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে সোমবার বেলা ১১টায় আগারগাঁওয়ের বিএসইসি কার্যালয়ে তাকে ডাকা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যর্থতার জন্য খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না কারণ জানিয়ে শোকজে লিখিত ব্যাখ্যাও চেয়েছে কমিশন।
আপনার মতামত লিখুন :