৩০টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পাওনা দাঁড়িয়েছে ২২০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বার্ষিক লাইসেন্স ফ্রি, রেভিনিউ শেয়ারিং, অপ্রদর্শিত ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাবদ এই বকেয়া জমেছে আইআইজিগুলোর। এগুলোর মধ্যে সিংহভাগ পাওনা অপ্রদর্শিত ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ খাতে। কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও আইআইজিগুলোর সঙ্গে বিটিআরসির এই দেনা-পাওনার হিসাব মিটছে না।
২০১২ সালে ১৫ বছর মেয়াদি ৩৭টি আইআইজি লাইসেন্স দেয় বিটিআরসি। পরবর্তীতে তিনটি লাইসেন্স বাতিল হয় এবং বর্তমানে আরও ছয়টি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রমে নেই। সবমিলিয়ে এখন ৩০টি আইআইজি কার্যক্রমে রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির এক হিসাব অনুযায়ী, আইআইজি থেকে বার্ষিক লাইসেন্স ফি বাবদ ৩০ লাখ, রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ ৬৭ কোটি ৬৮ লাখ, অপ্রদর্শিত ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ বাবদ ৬২ কোটি ৩০ লাখ, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল বাবদ ৪ কোটি ১৯ লাখ, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাবদ ৩৫ কোটি ৯৯ লাখ এবং বিলম্ব ফি বাবদ ৪৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা পাওনা বিটিআরসির। সবমিলিয়ে মোট পাওনা ২২০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
আইএসপিকে দেওয়া ব্যান্ডউইথ আইআইজির জন্য ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ। রেগুলেটরি অ্যান্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইন অন আইআইজি সার্ভিসেসের অনুচ্ছেদ ১৬.০৩ (ডি) অনুযায়ী, এই ব্যান্ডউইথ বিক্রির আয় থেকে একটি অংশ রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ বিটিআরসিকে দিতে হয় আইআইজিদের। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত ‘ব্যাকআপ ব্যান্ডউইথে’র নামে বিক্রি করা ব্যান্ডউইথের একটি বড় অংশ অবিক্রিত দেখিয়ে আসছিল আইআইজিগুলো। ২০২১ সালে বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারের সময় বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে। সে সময় অপ্রদর্শিত ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথের রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ ১০৯ কোটি টাকারও বেশি বিটিআরসির পাওনা নির্ধারিত হয়। তবে বিটিআরসির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদের অসহযোগিতায় এই পাওনা আদায় করতে পারেনি কমিশন। পরবর্তীতে কয়েক দফা মূল্যায়নের পর পাওনা নির্ধারিত হয় ৬২ কোটি ৩০ লাখে। এর ওপর মূসক ৯ কোটি ৩৫ লাখ এবং বিলম্ব ফি ৩০ কোটি মিলিয়ে ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ বাবদ আইআইজিগুলোর কাছে বিটিআরসির পাওনা ১০১ কোটি ৬৫ লাখ।
ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ বাবদ তিনটি প্রতিষ্ঠান ‘আমরা টেকনোলজিস’, ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি (বিএসসিসিএল) বকেয়া পরিশোধ করেছে। চারটি প্রতিষ্ঠান বকেয়া মওকুফ চেয়ে আবেদন করেছে। আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের কাছে সর্বোচ্চ ৫১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পায় বিটিআরসি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আর্থ টেলিকমিউনিশন্সের সর্বোচ্চ ৩২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। আমরা টেকনোলজিসের বকেয়া ২৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অনাদায়ী বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির অপারেশনাল কার্যক্রম শতভাগ স্থগিত করেছে বিটিআরসি। অবশ্য ১ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্ট করে বাকি টাকা ৩৬ মাস মেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধের আবেদন করেছে ‘আমরা’। যদিও প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সের অবশিষ্ট মেয়াদ আছে ২৮ মাস। এমন আবেদনকে যুক্তিহীন বলছে কমিশন।
লেভেল-৩ ক্যারিয়ার লিমিটেডের বকেয়া ২২ কোটি ২ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ ১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা ২৪টি কিস্তিতে পরিশোধের অনুমতির জন্য আবেদন করেছে লেভেল-৩। অবশ্য ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথের বিষয়ে কিছু জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি। পিয়ারেক্স নেটওয়ার্কের মোট বকেয়া ১৬ কোটি ২ লাখ টাকা।
এর মধ্যে অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথ বাবদ ১৫ কোটি ৬৫ লাখ, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল বাবদ ৩ লাখ এবং রেভিনিউ শেয়ারিং বাবদ ৩৪ লাখ টাকা বকেয়া। অভিযোগ উঠেছে একটি এনটিটিএন অপারেটর এবং বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানিতেও বকেয়া রয়েছে পিয়ারেক্সের। পিয়ারেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিটিআরসির বকেয়ার অংকটা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রত্যেক আইআইজিকেই এমন বকেয়া ধার্য করায় এরইমধ্যে বিটিআরসিতে নালিশ জানানো হয়েছে। আর বিএসসিসিএল ও ফাইবার অ্যাটহোমের সঙ্গে আমাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসা চলমান।
ব্যবসায়িক নিয়মে বকেয়া পরিশোধ করা হচ্ছে। ১০ কোটি ক্লাবের বাকি দুই সদস্য উইন্ডস্ট্রিম কমিউনিকেশন্স লিমিটেড (১১.৪৮ কোটি) এবং ডেলটা ইনফোকম লিমিটেড (১০.৫৯ কোটি)।
এ ছাড়াও বকেয়ার তালিকায় শীর্ষ দশে আরও রয়েছে ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল (৬.৭৪ কোটি), ম্যাক্সহাব (৬.৩১ কোটি) এবং আই-টেল লিমিটেড (৫.৬০ কোটি)। তালিকার বাকিরা হলো-সাইবার গেট, স্টারটেক টেলিকম, এক্সাবাইট, ভেলোসিটি নেটওয়ার্ক, বিডি হাব, ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেস, ভার্গো কমিউনিকেশন, নভোকম, এডিএন ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড, গ্লোবাল ফেয়ার কমিউনিকেশন, স্কাইটেল কমিউনিকেশন, এশিয়া অ্যালায়েন্স, বিডি লিংক, রেগো কমিউনিকেশন্স, ইন্ট্রাগ্লোব কমিউনিকেশন, প্ল্যানেট ইন্টারন্যাশনলা গেটওয়ে, তোরন লিমিটেড, ম্যাক্সনেট অনলাইন এবং করোনেট কর্পোরেশন।
এমন প্রেক্ষাপটে বকেয়া অর্থ আদায়ে ৩০ দিনের সময় দিয়ে আইআইজিগুলোকে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি। আগামী ১৭ জানুয়ারি এই সময়সীমা শেষ হবে বলে জানা গেছে। তবে বকেয়া অর্থের পরিমাণে আপত্তি আছে আইআইজিগুলোর।
মূসকের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথের হিসাব সঠিক নয় বলে দাবি আইআইজিদের। আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইআইজি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুল হাকিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, একই ইন্টারনেট সেবার বিপরীতে দুইবার মূসক দিতে হচ্ছে। গ্রাহকের কাছে ইন্টারনেট বিক্রির সময় তারা মূসক দিচ্ছে, সেটি সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছি। আবার বিটিআরসিকে মূসক দিতে হচ্ছে। উপরন্তু, রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের বিপরীতে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের থেকে মূসক নেওয়া হয় না। তাহলে শুধু আমরা কেন দিব? বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির থেকে আলোচনা করেও কোনো ফল হয়নি। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হই এবং রিট করি। আদালত এ বিষয়ে বিটিআরসির কাছে জবাবদিহি চেয়েছে কিন্তু তারা কিছু জানায়নি। ফলে আদালত থেকে এখনো সিদ্ধান্ত আসেনি। আর অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথের বিষয়ে সব আইআইজির ক্ষেত্রে সমানভাবে হিসাব হয়নি। কোম্পানিভেদে ব্যান্ডউইথের পরিমাণও ভিন্ন। আর ২০২৪ সালে এসে ২০১৬ সালের হিসাব করলে তো হবে না। প্রতিবছর তো অডিট হয়। ২০২১ সালে এসে এ বিষয়ক ট্যারিফ নির্ধারিত হয়েছে। হিসাব করলে সে সময় থেকে করা উচিত। এ বিষয়ে বিটিআরসির সঙ্গে সরাসরি বসে আলোচনা করব।
আর্থি টেলিকমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন বলেন, ক্যাশ সার্ভারের জন্য সিস্টেম লস এবং গুণগত মানের জন্য বাফার জোন রাখতে হয়। কিন্তু এ বাবদ কত শতাংশ রাখা হবে সেটা আইআইজি গাইডলাইনে নেই। আবার বিটিআরসি থেকে ক্যাশ সার্ভার রাখতে বলা হয়েছে কিন্তু ক্যাশ ফিলিংয়ের জন্য ব্যান্ডউইথ রাখতে হয়। বিষয়টি বিটিআরসি বিবেচনায় নিচ্ছে না। আবার অন্যান্য ক্যাটাগরির লাইসেন্সিদের জন্য রেভিনিউ শেয়ারিং ১ থেকে ৩ শতাংশ কিন্তু আইআইজিদের ১০ শতাংশ দিতে হয়। পাশাপাশি ১ মেগাবিট প্রতি সেকেন্ডের ব্যান্ডউইথ বিক্রয়মূল্য ৩৬০ টাকা দরে হিসাব করে বিটিআরসি।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাজারে দাম কমে যাওয়ায় এটিকে ২০০ টাকারও নিচে বিক্রি করতে হয়। অনেক সময় ব্যান্ডউইথের সঙ্গে ক্যাশ ব্যান্ডউইথ প্যাকেজ করে আইআইজিগুলো বিক্রি করছে, শুধু ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। অন্যদিকে ক্যাশ সার্ভার সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার নির্দেশনা রয়েছে বিটিআরসির পক্ষ থেকে। এর কোনো কনটেন্ট আলাদাভাবে বিক্রি করা যায় না। তাহলে ক্যাশ বাবদ যে অপ্রদর্শিত ব্যান্ডউইথের কথা বিটিআরসি বলছে, সেই হিসাব বাস্তবিক নয়।
এ বিষয়ে বিটিআরসির মিডিয়া উইং থেকে জানানো হয়, মূসকের বিষয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এখতিয়ারভুক্ত হওয়ায় এ বিষয়ে আইআইজি ও আইআইজি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত আবেদনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বোর্ডকে অবগত করা হয়েছে। মূসকের বিষয়ে জাতীয় এনবিআর থেকে কোনো নির্দেশনা পেলে তদনুযায়ী বিটিআরসি তা প্রতিপালন করবে।
আইআইজিগুলোর রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ওপর উৎসে মূল্য সংযোজন কর কর্তন ও আদায় বিধিমালা-২০২১ এর বিধি ৩(৫) এর অধীনে ১৫ শতাংশ কর আরোপের বিষয়টি নিয়ে আইআইজি অ্যাসোসিয়েশন হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং-৪১৩৫/২০২৪ দায়ের করেছে। গত ১৫ ডিসেম্বর ওই মামলায় আদেশের জন্য দিন ধার্য ছিল এবং ওই তারিখে কমিশন আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করে।
এ ছাড়াও, এনবিআর প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শুনানিতে উপস্থাপন করে। শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ মামলাটি ‘আউট অব লিস্ট’ মর্মে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। কাজেই বর্ণিত মামলায় আদালত থেকে কোনো ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ না থাকায় বিটিআরসি থেকে ওই বিষয়ে যেকোনো আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণে কোনো বাধা নেই।
বিটিআরসি আরও জানায়, আইআইজিদের আপস্ট্রিম এবং ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়ায় এ বিষয়ে কমিশন থেকে কমিটি গঠিত হয়। কমিটি কর্তৃক আইআইজি অপারেটরদের অপারেশনাল কার্যক্রম থেকে আপস্ট্রিম ও ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথের পার্থক্য নির্ধারণের কথা থাকলেও ওই সময়ে যাচাই করার মতো সঠিক তথ্য না পাওয়ায় ২০১৬ সালে বিটিআরসিতে স্থাপিত ‘ডিআইএস সিম্টেম’ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং আইআইজি অপারেটরদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ান্তে ২০১৬ সাল থেকে অপ্রদর্শিত আয়ের হিসাব নির্ধারণ করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :