ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

পি কে হালদারকে ফেরাতে পারবে কি সরকার

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ১২:১০ এএম

পি কে হালদারকে ফেরাতে পারবে কি সরকার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ভারতে জামিনের পর পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে ঢাকায়। বাংলাদেশে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে করা দুদকের মামলায় গত বছরের অক্টোবরে পি কে হালদারকে ২২ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। অন্যদিকে প্রায় এক বছর শুনানির পর কলকাতার আদালত মনে করেছেন, যে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে পি কে হালদার ও তার দুই সহযোগীর জামিন মঞ্জুর করা যায়। সে কারণে গতকাল শুক্রবার তারা জামিন পেলেন।

প্রশান্ত কুমার হালদার, শিব শংকর হালদার ও পি কে হালদার নামে ভারতে কাগজপত্র তৈরি করা হয় বলে জানান সে দেশের গোয়েন্দারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হলেও গত সাড়ে তিন বছরে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার দুই মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি গত চার মাসে। দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের উচিত ২০ বছরের দণ্ডিত অর্থ লুটপাট ও পাচারকারী পি কে হালদারকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

একটু-আধটু পুকুর নয়, এ যেন সাগর চুরি। ফাঁকা করেছেন ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং মিলিয়ে চার চারটি প্রতিষ্ঠান। লুট করা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এসব আর্থিক কেলেঙ্কারির পেছনে নায়ক হলেন পি কে। মানুষের আমানত লুট করে তছরুপ করার নায়ক তিনি। কাগুজে কোম্পানি খুলে সুকৌশলে অর্থ লুট করে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে কীভাবে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট করে সেগুলোর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন পি কে। নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে, প্রভাব খাটিয়ে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধসিয়ে দেওয়ার নায়ক তিনি। ঋণের নামে টাকা লোপাট, নামে-বেনামে পুঁজিবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কের বিরুদ্ধে।

এর আগে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচারে অভিযুক্ত পি কে হালদারসহ তিনজনকে জামিন দিলেন কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টের নগর দায়রা আদালত। গতকাল শুক্রবার তারা জামিন পান। পি কের সঙ্গে জামিন পেয়েছেন স্বপন মিস্ত্রি ওরফে স্বপনকুমার মিস্ত্রি, উত্তম মিস্ত্রি ওরফে উত্তমকুমার মিস্ত্রি।

আদালতের আদেশ অনুসারে, অভিযুক্ত তিনজনকে ১০ লাখ রুপির বন্ড জমা দিতে হবে। একই সঙ্গে জমা দিতে হবে ৫ লাখ রুপির লোকাল বন্ড (আদালত চত্বরের পরিচিত কেউ); সব মিলিয়ে ১৫ লাখ রুপি বন্ড জমা দিতে বলা হয়েছে প্রত্যেককে। একই সঙ্গে শর্ত দেওয়া হয়েছে, মামলা চলাকালীন তাদের আদালতে হাজিরা দিতে হবে। এমনকি রাজ্য বা দেশ ত্যাগ করা যাবে না। ঠিক কী শর্তে তাদের জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে চলাফেরার ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং আদালতে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা পুলিশের কাছে দৈনিক বা প্রতি সপ্তাহে অথবা প্রতি মাসে হাজিরা দিতে হয়। এ ছাড়া প্রয়োজনে জামিন পাওয়া ব্যক্তির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারে পুলিশ।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার মামলাটি শুনানির জন্য আদালতে ওঠে। পি কের জামিনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন আইনজীবী মিলন মুখার্জি। তিনি বলেন, আড়াই বছর হয়ে গেছে। ভারতীয় আইন অনুযায়ী মানি লন্ডারিং মামলায় অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সাত বছর জেল হতে পারে। কিন্তু তার আগে আড়াই বছর জেলহেফাজতে থাকলে তাকে জামিন দেওয়ায় কোনো সমস্যা থাকতে পারে না। তাহলে এখানে সমস্যা কোথায়? এর বিরোধিতা করেন ইডির আইনজীবী অরিজিৎ চক্রবর্তী। দুই পক্ষের শুনানির পর বিচারক প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় কোর্ট মুলতবি করে দেন। এরপর শুক্রবার বিচারক তাদের শর্ত সাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর করেন। ৯ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর ৫ লাখ রুপির বিনিময়ে জামিন পেয়েছিলেন পি কের ভাই প্রাণেশ হালদার, আমিনা সুলতানা ওরফে শর্মি হালদার ও ইমন হোসেন। তাদের জানানো হয়েছিল, এই সময়কালে তারা ভারতের বাইরে যেতে পারবেন না এবং আদালতে প্রতিটি শুনানিতে হাজিরা দিতে হবে।

আদালত সূত্রে জানা যাচ্ছে, সব প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে এক সপ্তাহ। অর্থাৎ, অভিযুক্ত হালদারদের বাকি তিনজনের জেল থেকে বের হতে সময় লাগবে সাত দিনের মতো। ২০২২ সালের ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বৈদিক ভিলেজ থেকে হালদারদের গ্রেপ্তার করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। পরে নানা জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালিয়ে হালদারের আরও পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে দেশটিতেই বন্দি হালদারেরা। প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২, অর্থাৎ অবৈধভাবে অর্থ পাচার এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছিল ইডি। পি কে হালদারসহ পাঁচ পুরুষ সহযোগীকে রাখা হয়েছিল কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে। নারী সহযোগী আমিনা সুলতানা ওরফে শর্মি হালদারকে রাখা হয়েছিল কলকাতার আলিপুর সংশোধনাগারে। বাংলাদেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদার নামে-বেনামে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অর্থ পাচার আইনে পাঁচ সহযোগীসহ তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পি কে হালদারসহ তার সহযোগীদের ৮৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তারা পি কে এবং তার সহযোগীদের ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ পেয়েছে বলেও জানিয়েছে। তখন কলকাতার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ আদালতে তোলা হয় পি কে হালদারকে। তখনই আদালতকে এসব কথা জানায় ইডি। এর আগে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পি কের প্রাসাদসম বাড়িসহ অনেক সম্পদের সন্ধান পায় ইডি। বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় অভিযুক্ত পি কে ভারতে শিবশংকর হালদার নামে পরিচিত।

ইডি বলেছে, শিবশংকর হালদার পরিচয় দিয়ে ভারতের একাধিক সরকারি পরিচয়পত্র, যেমন: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেশন কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর দপ্তরের পরিচয়পত্র পিএএন বা প্যান, নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ইত্যাদি জোগাড় করেছিলেন।

ইডি জানায়, ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পি কে ও তার সহযোগীদের ৪৪টি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির হদিস পায় তারা। পি কের ৪৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, যেখানে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ক্যাশ রয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় সাতটি ফ্লাটসহ প্রায় ৪০টি সম্পত্তির হদিস পেয়েছে ইডি। তাদের আছে অন্তত ৬০ কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায় পি কের সাতটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে।

পি কে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন তিনি। এই চার কোম্পানি হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এ চারটি ছাড়াও একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রয়েছে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ।

অস্তিত্বহীন ৩০-৪০টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণের নামে জালিয়াতি করে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সরিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি ও পিপলস লিজিং থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে জামানত নেই বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে গড়ে তোলেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে। এর মধ্যে রয়েছে পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ট্রাভেল, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি, সুখাদা লিমিটেড, আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, রেপটাইল ফার্মসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ছিল পি কের আত্মীয়রা।

মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের নামে প্রতিষ্ঠান খোলা হয়ে। ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ ও সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দীও আছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।

২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় প্রথম পি কের নাম সামনে আসে। এ সময় দুদক যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে, তাদের মধ্যে পি কে একজন। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি দুদক পি কের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করে। পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান গ্রামে পি কের জন্ম। বাবা প্রয়াত প্রণেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। তার মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পি কে হালদারেরা দুই ভাই। তিনি ও প্রীতিশ কুমার হালদার দুই ভাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ব¦বিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পি কে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি বনে যান অদৃশ্য ইশরায়।

আরবি/জেডআর

Link copied!