আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষেধাজ্ঞার পরও বিকট শব্দে আতশবাজি-পটকা ফাটিয়ে উদযাপিত হয়েছে নতুন বছর ২০২৫। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজি ও ফানুস উড়িয়ে ২০২৫ সালকে স্বাগত জানায় দেশবাসী। ইংরেজি নববর্ষ উদযাপিত করতে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে মাদক সেবন চলেছে লাগামছাড়া। গত মঙ্গলবার রাতভর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আটটি বিশেষ টিম ঢাকার বেশ কয়েকটি নামিদামি হোটেলে অভিযান চালিয়ে অবৈধ বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করেছে। সংস্থাটি সারা দেশে চার দিনের অভিযানে ৩৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকার অভিজাত এলাকাসহ দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তৎপর ছিল। অলিতে-গলিতে এবং প্রতিটি রাস্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে গান-বাজনা, হই-হুল্লোড় ও আতশবাজির উচ্চ শব্দের কারণে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে শব্দদূষণের প্রতিকার চেয়ে ফোন আসে সহস্রাধিক। আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়াতে গিয়ে রাজধানীতে শিশুসহ দগ্ধ হয়েছে পাঁচজন। গত বছরের মতো এবারও মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক লাইনের ওপর একাধিক ফানুস এসে পড়েছে।রাতভর কর্মব্যস্ত থেকে ডিএমটিসিলের কর্মীরা তা অপসরণ করেছে মেট্রোরেল চালু করার আগেই।
নববর্ষ নির্বিঘ্ন ও নিরাপদে উদযাপানের লক্ষ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যদিও তাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো, ফানুস ওড়ানো এবং বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে নগরবাসী। গত সোমবার এ ঘটনায় ডিবি-লালবাগ চকবাজার এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ আতশবাজি, পটকা ও বিস্ফোরক উদ্ধারসহ সাজ্জাদ হোসেন রাহাত (৪২) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তার কাছ থেকে ১০টি কার্টন ও ১০০টি প্যাকেটের মধ্যে রক্ষিত অবস্থায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ আতশবাজি, পটকা ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়।
পাঁচ তারকায় অভিযান: ঢাকা মহানগরীর অভিজাত এলাকাসহ দেশব্যাপী বিশেষ অভিযানে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি গত মঙ্গলবার রাতভর সারা দেশে তল্লাশি ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছে। শুধু ঢাকায় আটটি বিশেষ টিম অভিজাত এলাকাসমূহে বিশেষ অভিযান চালায়। ঢাকাস্থ হোটেল ওয়েস্টিনে পরিচালিত বিশেষ অভিযানে ১৩৬ বোতল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ ও ৩২৬ ক্যান বিয়ার, হোটেল রেঁনেসায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ ৩২ বোতল, হোটেল রিজেন্সিতে অভিযান চালিয়ে মদ ৯১ বোতল ও ৩৬৭ ক্যান বিয়ার এবং ঢাকার শেরাটন, বনানী থেকে ছয় বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া উত্তরার কিং ফিশার রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে ৬৭ বোতল বিদেশি মদ ও ১৬ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে এবং মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।
থার্টি ফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ২৮-৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযানে ১ হাজার ৫০৬টি অভিযান পরিচালনা করে ৩৬৮টি মামলা দায়েরপূর্বক ৩৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযান পরিচালনাকালীন ৪২ হাজার ৪১ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৩৫ বোতল ফেনসিডিল, ৩৭৬ বোতল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলাতি মদ, ৭০৯ ক্যান বিয়ার, টাপেন্টাডল ট্যাবলেট ১৯০৯ পিস, চোলাই মদ ৬৫২.৭ লিটার, ৬৬.২৪ কেজি গাঁজা এবং ২ লাখ ৯৭ হাজার ৩৯৭ টাকা উদ্ধার ও জব্দ করা হয়েছে।
শব্দদূষণেই ৯৯৯-এ ১১৮৫ অভিযোগ: ৩১ ডিসেম্বর খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণের প্রাক্কালে উচ্চ শব্দে গান-বাজনা, হই-হুল্লোড় ও আতশবাজির শব্দদূষণ প্রতিকারে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ১ হাজার ১৮৫টি অভিযোগ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর থেকে ৩৮৭টি এবং দেশের অন্যান্য স্থান থেকে ৭৯৮টি অভিযোগ এসেছে। গতকাল বুধবার ৯৯৯-এর গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে ৯৯৯-এর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশকে জানিয়ে প্রতিকারের চেষ্টা করা হয়েছে।
আনোয়ার সাত্তার বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাবএইডের পাশে স্বপ্ন শপিং মলের সামনে ফানুস থেকে আগুন ধরে যায়। ৯৯৯ থেকে খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের একটি অগ্নিনির্বাপক দল রওনা দেয়। তারা পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলে।
এবারও মেট্রোরেলের তারে ফানুস: ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে মেট্রোরেলের লাইন ও এর আশপাশের এলাকায় ফানুস না ওড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছিল, তবে আটকানো যায়নি। এবারও মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক লাইনের ওপর একাধিক ফানুস এসে পড়েছে। তবে মেট্রোরেল চালু করার আগেই তা অপসরণ করা হয়েছে। তাই প্রথম শিডিউল থেকে স্বাভাবিকভাবেই চলেছে মেট্রোরেল। গতকাল বুধবার সকালে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মহাম্মদ ইফতিখার হোসেন বলেন, ‘আমাদের অনুরোধ রাখল না। মেট্রোরেল লাইনের আশপাশের এলাকায় বহু ফানুস ওড়ানো হলো এবং সেগুলো লাইনে এসে পড়েছে। আমাদের সার্ভিস টিম রাতভর এই ফানুস পরিষ্কার করেছে এবং নির্দিষ্ট সময়ে মেট্রোরেল পরিচালনা করা হয়েছে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মতো এবারও উত্তরা থেকে মতিঝিল পুরো লাইনে আটকে থাকা পাঁচটি ফানুস অপসারণ করা হয়েছে। ‘ফুট পেট্রলিং’ পরিচালনা করে ওসিএস এবং পিওয়ে সেকশনের সমন্বয়ে বিভিন্ন স্থানে ট্রাক, ভায়াডাক্ট ও ওসিএস থেকে এসব ফানুস অপসারণ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত দুই বছর ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ওড়ানো ফানুস গিয়ে মেট্রোরেলের তারের ওপর পড়ে। এতে বিপত্তিতে পড়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। গত বছর ৩৮টি ফানুস অপসারণ করা হয়েছিল মেট্রোরেলের তার থেকে।
ইংরেজি নববর্ষে শিশুসহ দগ্ধ ৫: খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়াতে গিয়ে শিশুসহ পাঁচজন দগ্ধ হয়েছেন। তারা হলো মো. ফারহান (৮), মো. সিফান মল্লিক (১২), সুমাত (২০), মো. সেন্টু (৪৫) ও তফসির (৩)। গত মঙ্গলবার রাত ১২টার পরপরই এসব ঘটনা ঘটে। দগ্ধ অবস্থায় তাদের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসলে একজনকে ভর্তি করা হয়, বাকি চারজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। গতকাল বুধবার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক (আরএস) ডা. শাওন বিন রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ডা. শাওন বিন রহমান জানান, নববর্ষে আতশবাজি ও পটকা ফোটাতে গিয়ে শিশুসহ পাঁচজন দগ্ধ হন। এখানে পাঁচজন এসেছে। তাদের মধ্যে ফারহানের শরীরের ১৫ শতাংশ, সিফান মল্লিকের ১ শতাংশ, সুমাতের ১ শতাংশ, সেন্টুর ২ শতাংশ ও তফসিরের ২ শতাংশ পুড়ে গেছে। এছাড়া আরেক শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন বছর বরণ করতে রাস্তাঘাটে পটকা ফোটানোর কারণে তারা দগ্ধ হয়েছে। ফারহানকে ভর্তি করা হয়েছে এবং অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ডিএনসির ঢাকা মেট্রোপলিটন কার্যালয়ের (উত্তর) উপপরিচালক শামীম আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের অ্যালকোহল বাজারজাতকরণ ও বার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে বার বন্ধ থাকলেও নববর্ষ উপলক্ষে কিছু আয়োজক হোটেলগুলোর বলরুম ভাড়া নিয়ে ডিজে পার্টির আয়োজন করেছিল। যেখানে এসব মদ সরবরাহ করে গ্রাহকদের কাছে পরিবেশন করা হচ্ছিল। ডিএনসির পক্ষ থেকে হোটেল কর্তৃপক্ষগুলোকে বলা হয়েছিল থার্টি ফার্স্টের পার্টির আয়োজনে সেগুলোয় অ্যালকোহল না রাখতে। কিন্তু যারা আয়োজন করেছে তারা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এটা করেছে।
অভিযানের খবর পেয়ে আয়োজকরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তবে বিস্তারিত তথ্য বের করে এর পেছনে যারা দায়ী সবাইকে আইনের আওতায় আনব।
আপনার মতামত লিখুন :