বছরজুড়ে নানা অঘটন ও ঘটনার আলোড়নে ২০২৪ সাল এরই মধ্যে স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব ইতিহাসে। ক্ষমতা দখল ও পাল্টা দখলের ইস্যু তৈরি হয়েছে। বেড়েছে মৃত্যুর মিছিল। কোথাও সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান নাড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত। কোথাও নির্বাচনের মাধ্যমে পাল্টেছে শাসক। ২০২৪ সালকে তাই ক্ষমতার পালাবদলের বছর বললেও অত্ত্যুক্তি হবে না।
চলতি বছর বিশ্বের কয়েকটি দেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। রেকর্ড ভেঙে নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে নতুন বছরে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অনেকটা পূর্বনির্ধারিত জয়েই রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থান ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের সর্বগ্রাসী আক্রমণের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার এসব পালাবদল বিশ্বরাজনীতির জটিল সমীকরণকে নতুন রূপ দিয়েছে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ভূমিকম্প দিয়ে। বছরের প্রথম দিন বিভিন্ন দেশ যখন বর্ষবরণের আনন্দে মেতে ওঠে, সে সময়ই প্রকৃতির রুদ্ররোষে পড়ে জাপান। বছরের প্রথম দিনেই ৭.৬ মাত্রার তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে উদীয়মান সূর্যের দেশটি। আঘাত হানে সুনামিও। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ। এরপর মালদ্বীপ-ভারত কূটনৈতিক সংঘাত ছিল আলোচনায়। যদিও পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে যায়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
২০২৪ সালে বিশ্বের প্রায় ৩৭০ কোটি মানুষের জন্য ভোট দেওয়ার সুযোগ এসেছিল। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক জনসংখ্যা। ২০২৪ সালকে জাতিসংঘ ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনি বছর’ হিসেবে অভিহিত করেছিল।
কারণ, দি আইডিয়া ইন্টারন্যাশনালের ‘দ্য ২০২৪ গ্লোবাল ইলেকশন্স সুপার-সাইকেল’ লাইভ রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, ইতিমধ্যে ২০২৪ সালে বিশ্বের ৭৪টি দেশের মধ্যে ৭৩টি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর বিশ্বরাজনীতির আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এ বছর যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ৫টি দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেক্সিকো ও যুক্তরাজ্যের ভোটাররা নতুন নেতা বেছে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে ফিরে এসেছেন। আর ভারতে নরেন্দ্র মোদি। এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছেন রাশিয়ায় ভøাদিমির পুতিনও।
বিশ্বজুড়ে নির্বাচনি ঘনঘটার মধ্যে সবচেয়ে চমক জাগানিয়া নির্বাচন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্প একটি অনন্য রেকর্ড গড়েন। আমেরিকার ১৩০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা প্রথম প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হলেন ট্রাম্প। এছাড়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার রায়, নির্বাচনের আগে তাকে হত্যাচেষ্টাসহ নানা কারণে এই নির্বাচনের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল সবচেয়ে বেশি। আদালত মে মাসে ব্যবসায়িক রেকর্ড জালিয়াতির ৩৪টি অভিযোগের কারণে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ার বাটলারে এক সমাবেশে ট্রাম্প একটি হত্যাচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে যান। উপরন্তু ডেমোক্র্যাটদের চাপের মুখে জো বাইডেনের নির্বাচনি লড়াই থেকে সরে যাওয়া এবং ফলশ্রুতিতে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদে কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনকে একটি অনন্য মাত্রা দিয়েছিল।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি: এদিকে বছরজুড়ে উত্তপ্ত ছিল মধ্যপ্রাচ্য। তবে বছরের শেষদিকে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতসহ সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় সিরিয়া সংঘাত। বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ৮ ডিসেম্বর মিত্রদেশ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। আর এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের টানা ৫৩ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি এবং কৌশলগত দিক থেকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলটিতে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা, ইয়েমেন, সৌদি আরব, ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যকার পারস্পরিক সংঘাত বছরজুড়েই রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ অঞ্চলের সংঘাতগুলোতে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। যাদের অধিকাংশই নারী এবং শিশু। গুরুতর আহত হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। ধ্বংস হয়েছে ৫০০টির বেশি স্কুল ও হাসপাতাল। হাজারো বাড়িঘর, ধর্মীয় স্থাপনা, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে।
২০২৪ সাল জুড়ে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা মূলত এ অঞ্চলে ইরান এবং সৌদি আরবের প্রভাববলয়ের দ্বন্দ্ব, বরাবরের মতো ইসরায়েলের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর চলমান লড়াইকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তপ্ত বছরটিতে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন এবং ইসরায়েলের সংঘাত এবং দ্বন্দ্ব আরও গভীর হয়েছে। তেহরান তার মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে এই অঞ্চলে তার প্রভাববলয় ধরে রেখেছে। একই সঙ্গে বিস্তৃত করেছে। তবে সিরিয়ার ঘটনায় বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে তেহরান। অন্যদিকে, মূলপ্রতিদ্বন্দ্বী তেল আবিব এবং প্রভাবশালী তুরস্ক সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ সৌদি আরবের বহুমুখী আচরণ এবং তেহরানপন্থি হুতি বিদ্রোহী এবং হিজবুল্লাহর দ্বৈতাচরণ এসব সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতি এবং স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
এশিয়া পরিস্থিতি: ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে লাগাতার নাশকতার মধ্যেই পাকিস্তানে হয় জঙ্গি হামলা। পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (পিআইসিএসএস) হিসাবে, এ বছরের প্রথম ৮ মাসে জঙ্গি হামলায় দেশটিতে ৭৫৭ জন নিহত হয়েছেন। শুধু আগস্ট মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ২৫৪ জন। গত ছয় বছরের মধ্যে কোনো এক মাসে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা। এদিকে জেলে বসেই আমজনতার জন্য বিশেষ বার্তা দেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে জঙ্গিরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। দুটি প্রদেশই আফগানিস্তান সীমান্তে অবস্থিত। পাকিস্তানের ভেতরে হামলার জন্য আফগানিস্তানভিত্তিক তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) বারবার দায়ী করে আসছে ইসলামাবাদ। তবে কাবুলের তালেবান সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এদিকে বছর শেষে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান।
শ্রীলঙ্কায় গণবিক্ষোভের মুখে রাজাপক্ষে সরকারের পতন হয়। এরপর অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে জিতে ৫৫ বছর বয়সী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে তিনি ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) নামে রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দেন। দলটিকে ভারতের প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ঘনিষ্ঠ বলেই দেখা হয়।
এদিকে বাংলাদেশ লাগোয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এর প্রায় পুরোটাই এখন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এই আরাকান আর্মি রাখাইনের বৌদ্ধদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ২০০৯ সালে । রাখাইনের বর্তমান জনসংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। এর ৬০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৩৫ শতাংশ মুসলমান রোহিঙ্গা আর ৫ শতাংশ হিন্দু ও খ্রিস্টান। আরাকান আর্মি স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন দেখত একসময়। এখন তা বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রাখাইন রাজ্য। আর অন্যদিকে আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছিল জান্তা সরকার। ফলে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর খড়গহস্ত হবে বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আর তা যে ঘটছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢোকার মধ্য দিয়ে। ড. ইউনূস গত বুধবারই মালয়েশিয়ার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জানান যে গত কয়েক মাসে নতুন করে ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।
অন্যদিকে সম্ভবত চলতি বছরের আগস্ট মাসে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। পাশাপাশি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়। বছরের প্রায় শেষে এসেও এই কূটনৈতিক পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক উন্নতি হয়নি।
বছরজুড়ে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং বিশিষ্টজনরা মতামত দিয়েছেন। এদের মধ্যে আরব সেন্টারের গবেষণাবিষয়ক পরিচালক ইমাদ হার্ব বলেছেন, ইরান-সমর্থিত প্রক্সি (অ-রাষ্ট্রীয় শক্তি) গোষ্ঠীর শক্তিশালী ভূমিকা ২০২৪ সালে আরো বেড়েছে। হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতি বিদ্রোহীরা আঞ্চলিকভাবে ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর অবস্থান নিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, গাজা সংকটে ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমাধান প্রায় অনুপস্থিত। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতি মানবাধিকারের প্রশ্নকে উপেক্ষা করছে বলে তার মত। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে যথাযথ ইচ্ছার চেয়ে পারস্পরিক আঞ্চলিক স্বার্থই প্রকট হয়েছে ইরানসহ অন্যান্য দেশগুলোর তৎপরতায়।
ওয়াশিংটন ডিসির সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেলি কুলবার্টসন মনে করেন, গাজার চলমান ধ্বংসযজ্ঞের পুনর্গঠন এবং তীব্র মানবিক সংকট মোকাবিলা করতে বহু বছর সময় লাগবে। সামরিক অভিযান দীর্ঘায়িত হলে বাস্তুচ্যুতির সমস্যা অব্যাহত থাকবে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এই সংঘাতের পরিসমাপ্তি এক বা দুই বছরের মধ্যে দেখা যাবে না।
আপনার মতামত লিখুন :