আগামীকাল থার্টি ফার্স্ট নাইট। ওইদিন রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে আতশবাজির বর্ণিল আলো আর মুহুর্মুহু কান ফাটানো শব্দের বীভৎস তাণ্ডব। ফলে রাতটিকে ঘিরে রাজধানীবাসীর মধ্যে বিরাজ করছে আতশবাজি ও আগুন আতঙ্ক। বিশেষ করে শিশুসন্তানকে নিয়ে উদ্বেগ আর শঙ্কায় রয়েছেন অনেক মায়েরা। থার্টি ফার্স্ট নাইটে শব্দের মাত্রা এত তীব্র হয় যে, শিল্প এলাকার জন্য নির্ধারিত শব্দের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। এ ছাড়া ঢাকায় বায়ু ও শব্দদূষণ মারাত্মক স্তরে পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এদিকে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তবে খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণের রাতে উন্মুক্ত স্থানে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবছরই থার্টি ফার্স্ট নাইটে পুলিশের তরফ থেকে নগরীতে ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি না করতে নির্দেশনা দিলেও আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউ। ফলে প্রতিবছরই ফানুসের আগুনে আর আতশবাজির শব্দে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ঘিঞ্জি ঢাকায় আতশবাজি ও আগুন ধরিয়ে ফানুস উড়ানো একেবারেই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ফানুস উড়তে উড়তে বাড়ির ছাদে বা বৈদ্যুতিক তারে পড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরের দিন সকাল ৫টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে গাড়ি প্রবেশ সীমিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি এবং জরুরি সেবা ছাড়া অন্য গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে রাজধানীর পুরান ঢাকা, ধানমন্ডিসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৪৫টি আগুনের ঘটনা ঘটে। গত বছর থার্টি ফার্স্ট নাইটের আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস উড়ানোর কারণে প্রায় ১০০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে; যাতে আনুমানিক ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়। মেট্রোরেলের লাইনে ফানুস পড়ে থাকার কারণে মেট্রোরেল চলাচলে অন্তত ২ ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছিল। গত বছরও থার্টি ফার্স্ট নাইটে মেট্রোরেলের তারে আটকে ছিল বর্ষবরণের ৩৮ ফানুস।
অপরদিকে, মুখে কেরোসিন নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময় ভাতিজা ও দুই চাচা দগ্ধ হয়েছেন। ধানমন্ডির একটি বাড়িতে ফানুস পড়ে আগুন ধরে গেলে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইন সূত্রে জানা গেছে, থার্টি ফার্স্ট নাইটে শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সহযোগিতা চেয়েছেন ৫২৬ জন। যার মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগর এলাকা থেকে সেবাপ্রত্যাশী ছিলেন ১০৭ জন।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২৪ এই সময়ের মধ্যে বায়ুমান সূচক কখনোই ভালো অবস্থানে ছিল না। বায়ুমান সূচক ৫০ এর নিচে থাকলে ভালো বায়ু বলা হয়, সে ক্ষেত্রে গত ৭ বছরে নির্দিষ্ট দুই দিনে কখনোই বায়ুমান সূচক ৫০ এর নিচে ছিল না। তবে ২০২১-২২ সালে করোনাকালে কম আতশবাজি, পটকা, ফানুস পোড়ানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইটে রাত ১২টা বাজার কিছু পূর্ব থেকে আতশবাজি, ফানুস পোড়ানোর শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বায়ুদূষণও বাড়তে থাকে। বস্তুকণার দূষণের মাত্রা রাত ১টায় প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ২৪৯ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছায় যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
শব্দদূষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতে শুধু বায়ুদূষণ হচ্ছে এমনটি নয়, মারাত্মক শব্দদূষণও সৃষ্টি হচ্ছে। রাত ১১টা থেকে শুরু করে ১টা পর্যন্ত আতশবাজি ও পটকার তীব্র শব্দ শোনা যায়। শব্দদূষণে ক্যাপসের গবেষণার ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৩০ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১টার মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় গড়ে শব্দের মান ৪৮ থেকে শুরু করে ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত পাওয়া যায়।
কিন্তু এই শব্দের মাত্রা ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে সর্বনিম্ন ৮৫ ডেসিবেল থেকে শুরু করে গড়ে সর্বোচ্চ ১১০ ডেসিবেল পর্যন্ত এই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
রাজধানী জুরাইনের বাসিন্দা গৃহবধূ শাফনাজ ইসলাম জানান, তার একমাত্র সন্তানের বয়স ২ দুই বছর। গত বছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজির বিকট শব্দে আতঙ্কে তার সন্তান কেঁপে কেঁপে উঠছে আর অনেক চিৎকার করেছে। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করেও রেহাই মেলেনি। তিনি বলেন, এবারের থার্র্টি ফার্স্ট নাইটের উদযাপন নিয়ে ইতোমধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে আমার মনে। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম নামের এক ব্যাংকার বাবা বলেন, ‘আমার মেয়েও আতশবাজির শব্দে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকার দেয়। পুলিশের তরফ থেকে প্রতিবছরই বলা হয়, আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ কিন্তু তারপরেও মানুষ পুলিশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাড়ির ছাদে রাস্তায় বিকট শব্দে আতশবাজি ও ফানুস ওড়ায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডিএমপি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নিয়মিত টহল ও তল্লাশিচৌকি বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশি তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, উন্মুক্ত বা খোলা কোনো স্থানে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে পরিচয়পত্র ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া গুলশান, হাতিরঝিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি গুজব ও অপপ্রচার প্রতিরোধে সাইবার প্যাট্রোলিং জোরদারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে আগুনের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ফায়ার সার্ভিস। রাজধানীর প্রতিটি স্টেশনকে ওই রাতে স্ট্যানবাই রাখা হবে। যাতে কোথাও কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এ ছাড়া নগরবাসীকে ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি বন্ধে সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস।
ঢবিতে বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা: শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ৩১ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরবর্তী দিন সকাল ৫টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে গাড়ি প্রবেশ সীমিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি এবং জরুরি সেবা ছাড়া অন্য গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না। গতকাল রোববার প্রক্টর অফিসের এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ‘থার্টি ফাস্ট নাইট’ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ৩১ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরবর্তী দিন (১ জানুয়ারি, ২০২৫) সকাল ৫টা পর্যন্ত ঢাবি প্রবেশপথগুলোতে (শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, বার্ন ইউনিট, শিববাড়ি ক্রসিং, ফুলার রোড, পলাশী মোড় ও নীলক্ষেত) বৈধ আইডি কার্ডধারী শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি, জরুরি সেবা (অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, রোগী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য সরকারি গাড়ি) ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।
আপনার মতামত লিখুন :