বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। যা পুরো বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে মানুষের মনে। সাধারণ মানুষ মনে করে, দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে এক লুটেরাকে বিদায় করেছে আরেক লুটেরাকে মসনদে বসানোর জন্য নয়।
পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এরই মধ্যে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাট রোধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
তারেক রহমান বলেছেন, বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের কোনো নেতাকর্মী যদি কোনো ধরনের অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে তাহলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। বিএনপির শুদ্ধি অভিযানে অভিযুক্ত নেতারা তদন্তসাপেক্ষে দলীয় পদ হারাবেন। অথবা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন।
এদিকে তারেক রহমানের এই শুদ্ধি অভিযানের ঘোষণায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন সারা দেশের বিএনপির বড় বড় নেতারা। অভিযুক্ত এসব নেতার অনেকেই পদ হারানো এবং আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন।
সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার আলোচনা থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি অনেকটা স্বস্তিতে থাকলেও যত দিন যাচ্ছে ততই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে দলটি। বিশেষ করে দলীয় নেতাকর্মীদের লাগামহীন কর্মকাণ্ড এবং তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েই চলছে। এ ছাড়া আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতরে বিএনপিকে কোনঠাসা করার অপচেষ্টাও চলছে। পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের ভেতর অব্যাহত রয়েছে শুদ্ধি অভিযান।
সূত্র জানায়, সাংগঠনিকভাবে দল গোছানোর পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কৌশলী পথে এগোচ্ছে বিএনপি। বিভিন্ন দেশের বড় রাজনৈতিক দলের মতো সরকার ও দল পরিচালনার মধ্যে সীমারেখা টানতে চাইছে বিএনপি। এর আগে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এমন চিত্র দেখা গিয়েছিল দলের মধ্যে। এরই অংশ হিসেবে মহানগর, জেলা ও উপজেলা কমিটি পুনর্গঠনে তরুণ প্রজন্মের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও যোগ্য নেতাদের মূল্যায়নের চিন্তা-ভাবনা করছে দলের হাইকমান্ড। আর সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী ও ২০১৮ সালের দলীয় প্রার্থীদের রাখা হচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে।
সম্প্রতি বিএনপি অনুমোদিত ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ ১৩টি মহানগর ও জেলা কমিটি বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে এমন চিত্র। দলীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, আগামী দিনে দল ও সরকারের মধ্যে সীমারেখা তৈরির চেষ্টা করছে বিএনপি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কাযার্লয়ের সূত্র জানায়, দলের অনেক সাংগঠনিক কাজ থাকে। কিন্তু বেশি এমপি-মন্ত্রী যদি দলে থাকে তাহলে দল ও সরকার উভয়ের কাজ ব্যাহত হয়। তাই কমিটি পুনর্গঠনে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের মহানগর ও জেলা কমিটির শীর্ষ মসনদে পদায়ন করা হচ্ছে।
আবার যারা দলের আগামী নির্বাচনে এমপি প্রার্থী তাদের ছোট পদে বা অনেককে পদেই রাখা হয়নি। এতে একদিকে বিগত ১৭ বছরের ত্যাগী ও পরীক্ষিত সব নেতাকে মূল্যায়নের চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে জেলা বা মহানগরে প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রী ও এমপিদের একক আধিপত্য কমাতে কাজ করছে দলটি। ইতোমধ্যে দল ও সাবেক মন্ত্রী, এমপি আলাদা করার ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা করছে। তবে যোগ্যদের মূল্যায়ন করা দল ও সরকার পুরোপুরি আলাদা করাও খুব কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছে দলটির সিনিয়র নেতারা।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, যশোর খুলনা, সিলেট মহানগর, বরিশাল মহানগর, মাগুরা, মেহেরপুর, মৌলভীবাজার, কুষ্টিয়া, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক বা সদস্যসচিব পদে নতুন মুখের আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
তারুণ্যনির্ভরতা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মূলত এমন উদ্যোগ নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আবার তিনি সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের জন্য রেখেছেন চমকও।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার সঙ্গে যারা দল করেছেন তাদের অনেকের বয়স ৭০ বছরের বেশি। এবার মহানগর ও জেলা কমিটিতে পদ না পেলেও তারাই দলে সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী। দীর্ঘ ১৭ বছর তাদের লড়াই-সংগ্রাম মূল্যায়ন করবেন তিনি।
অন্যদিকে নতুন প্রজন্মকে আগামীর নেতৃত্বে তৈরি করতে পদ-পদবি দেওয়া হচ্ছে। এতে সমাজে নতুন শক্তির সঞ্চার করবে। দল থেকে এমপি আলাদা করার চিন্তার ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের আমলে ফিরে যাওয়া হচ্ছে কি না এটা সময়ই বলে দেবে। তবে এ পদক্ষেপে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে বিএনপির এক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, যোগ্যদের মূল্যায়নের জন্য বিএনপি শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে। যেটা সরাসরি তারেক রহমান দেখভাল করছেন। এই অভিযানে এমনও হতে পারে, অনেক যোগ্য নেতারা এমপি, মন্ত্রীর টিকিট পাওয়া থেকে বাদ পড়বেন। এবার যেটা হবে সেটা হলো বিএনপি দল এবং যোগ্যদের সামনে আনবে এবং দলীয় সংস্কার হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নীতিতে হাঁটছেন তারেক রহমান। জেলা বা মহানগরে মন্ত্রী-এমপিদের একক আধিপত্য কমাতে দল কাজ করছে। তা ছাড়া আগামী দিনে দল ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য তৈরির চেষ্টা করছে বিএনপি। এতে বিগত ১৭ বছরের ত্যাগী ও পরীক্ষিত সব নেতাদের মূল্যায়নের জায়গা থাকবে এবং বিএনপির নেতা এমপি ও মন্ত্রীদের একক আধিপত্য কমে যাবে, সবাই জনবান্ধব থাকবে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দলীয় নির্বাচিত এমপিরা সংসদে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন, আর দলের নেতারা সাংগঠনিক কাজে মনোযোগ দেবেন। যেটা নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হয়তো সেই চিন্তা করছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, এসব বিষয়ে দলীয়ভাবে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তবে সময় বলে দিবে কীভাবে সংগঠন কাজ করবে।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় এক শীর্ষ নেতা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, তারেক রহমান তার পিতার রাজনীতির দিকে এগোচ্ছেন।
যেমনটা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে যারা দলের সংসদ সদস্য বা মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা দলের দায়িত্বে থাকতেন না। আবার কেউ একসঙ্গে মন্ত্রী-এমপি ও জেলা বা মহানগরের শীর্ষ পদে থাকতে পারতেন না। বর্তমানে রাজনীতিতে এই প্র্যাকটিস নেই। তাই জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি তারেক রহমান তার বাবার দেখানো নীতিতেই হাঁটতে চাইছেন। যার ছাপ মহানগর ও জেলা কমিটিতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এমপি ও দল আলাদা করার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। তবে বিএনপিতে অনেক সংস্কার হবে। দলের পরিচয়ে কেউ কোনো ধরনের অপরাধ করতে পারবে না। আর অপরাধীদের দলের মধ্যে কোনো জায়গা হবে না বলে মন্তব্য করেন দলের এই শীর্ষ নেতা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিএনপি যাকে যেখানে যোগ্য মনে করে তাকে সেখানেই বসাবে। এটা দলের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত। তবে সারা দেশের নেতাদের আমলনামা তারেক রহমানের কাছে আছে। তিনি কোন নেতাদের এমপির টিকিট দিবেন আর কোন নেতাকে দিবেন না, সেটা দলীয় সিদ্ধান্তে ওঠে আসবে। একই সঙ্গে এ সময়ে যাতে অন্য দল থেকে সুবিধাভোগী অথবা হাইব্রিড যেন দলে যোগ দিতে না পারে সে ব্যাপারেও তিনি সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের এ কঠোর সিদ্ধান্ত জাদুর কাঠির মতো কাজ করতে শুরু করেছে মন্তব্য করেন তিনি।
এরই মধ্যে বিভিন্ন অপকর্মের কারণে গত ৩৬ দিনে ১৬৭ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের নেতাকর্মীরা বহিষ্কৃতদের মধ্যে রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :