ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন অনেক আওয়ামী নেতাকর্মী এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা। তেমনই এক উদাহরণ রাজধানীর নিউমার্কেটের চাঁদনী চকের ব্যবসায়ীদের সংগঠন চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের সভাপতি নিজাম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন হাওলাদার। আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের ঘনিষ্ঠ নিজাম-মনির গংয়ের ত্রাসের রাজত্ব এখনো বহাল রয়েছে চাঁদনী চক মার্কেটে।
নিজাম-মনিরের কমিটি বাতিল করে সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রশাসক নিয়োগ করলেও তাকে মার্কেটে প্রবেশই করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি হামলায় জড়িত থাকলেও, প্রভাব বিস্তার করে মামলা থেকে নাম কাটিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে নিজামের বিরুদ্ধে। চাঁদনী চকের দখল রাখতে উচ্চ আদালতকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন নিজাম উদ্দিন ও মনির হোসেন। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে মামলা ও হামলার হুমকি।
নিউমার্কেট এলাকার সবচেয়ে বড় বিপণিবিতান ‘চাঁদনী চক’। অভিযোগ উঠেছে, একাধিক ভবনে শত শত দোকান নিয়ে গঠিত মার্কেটটিতে দীর্ঘদিন ধরে লুটপাট চালিয়ে আসছিলেন সাবেক মেয়র তাপসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নিজাম উদ্দিন ও মনির হোসেন। তাপসের হাত ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতার সঙ্গে সখ্যও ছিল নিজাম ও মনিরের। তাদের এই পরিচয়ের সপক্ষে একাধিক তথ্যবহুল ছবি রয়েছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে। ২০১৯ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে মন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘হাস্যোজ্জ্বল’ পরিবেশে সাক্ষাৎ করেন নিজাম।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনের সময় তাপসের প্রচারণাকর্মীদের সঙ্গেও ছিলেন নিজাম। প্রশ্নবিদ্ধ সেই নির্বাচনে বিজয়ী হলে তাপসকে ফুলেল অভ্যর্থনা দেন নিজাম, মনিরসহ তাদের কমিটির অন্যান্য নেতা। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাপসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেছে নিজাম উদ্দিনকে। নগর ভবনে একাধিক সভায় তাপসের আসনের পেছনে থাকতেন নিজাম ও মনির। ২০১৮ সালের রাতের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তখনো তাপসকে ‘সর্বসাধারণের নয়নের মণি’ উল্লেখ করে অভিনন্দন বার্তা দিয়েছিলেন নিজাম। একই বছরের অক্টোবরে গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমদাদুল হকের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন নিজাম উদ্দিন। সেই ঘটনার একটি ছবি নিজের ফেসবুকে দিয়ে এমদাদকে ‘কাকু’ হিসেবে সম্বোধন করেন। গত জানুয়ারিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীরকে চাঁদনী চক বিজনেস ফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করেছিল নিজাম নেতৃত্বাধীন কমিটি। পলকের আশীর্বাদে সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে চাঁদনী চকের দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ সভাপতি হয়ে বসে আছেন নিজাম।
নিজামের তুলনায় কম যান না তার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন হাওলাদার। তাপস ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ছিল তার সখ্য। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ক্যাডার লিয়াকত সিকদারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন মনির। ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ী উপজেলার যশলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন কিনেছিলেন মনির। এ ছাড়া একাধিক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে সখ্য রয়েছে মনিরের।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতন হলেও পতন হয়নি নিজাম-মনির গংদের। তাদের কমিটির নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে মার্কেটটি উদ্ধার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নেমে নির্বচনে কারচুপি ও সদস্যদের হয়রানি-নির্যাতনসহ নানান অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে কমিটি বিলুপ্ত করে একজন প্রশাসক নিয়োগ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। গত ২৩ অক্টোবর নিয়োগ পেয়ে এখনো মার্কেটে কমিটির কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি প্রশাসক নুর ইসলাম। একাধিকবার তাকে ফোরামের কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেন নিজিম ও মনিরের সহযোগীরা। এমনকি প্রশাসককে দায়িত্বও বুঝিয়ে দেয়নি তাদের কমিটি। দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া এবং কার্যালয়ে প্রবেশে বাধার সম্মুখীন হয়ে গত ১১ ডিসেম্বর নিউমার্কেট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন প্রশাসক নুর ইসলাম। অবশ্য অদ্যাবধি প্রশাসকের জিডির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি নিউমার্কেট থানার পুলিশকে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ফোরামের নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ায় মার্কেটটির পুরোনো ব্যবসায়ী হাফেজ মো. ইসরাইলকে অন্যায়ভাবে সদস্যপদ বাতিল করেন নিজাম ও মনির। নিজের সদস্যপদ ফিরে পেতে তখন সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাভার উপজেলা কার্যালয়ে আবেদন করেন ইসরাইল। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নেমে চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের কমিটি বাতিলি ও প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা কে এম শহীদুজ্জামান।
পরবর্তী সময়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর কমিটি বাতিল করে শহর সমাজসেবা কার্যালয়-১ এর কর্মকর্তা মো. নুর ইসলামকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মার্কেটটির একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নিজাম ও মনির গংদের আতঙ্কে প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি তারা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, একটা সময়ে চাঁদনী চক মার্কেটের কর্মচারী ছিলেন নিজাম। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয় ও সাবেক মেয়র তাপসের প্রভাব খাটিয়ে চাঁদনী চক মার্কেটে দোকান মালিক বনে যান।
ভোট কারচুপির মাধ্যমে সভাপতি হয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছেন নিজাম উদ্দিন। বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের ডেকে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। দোকানে তালা লাগিয়ে চাঁদা আদায়, দোকান দখলেরও বহু অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, নিজাম ও মনির চাঁদনী চক মার্কেটের সব বিশৃঙ্খলা ও বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। শত শত ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। চাপে রাখতে ব্যবসায়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অসত্য, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং তাদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে নানা অভিযোগ তোলা হতো।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি হামলায় জড়িত থাকলেও অদৃশ্য কারণে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে নিজামের নাম। নিজামের নাম বাদ দেওয়া মামলার আবেদন ও এজাহারের কপি রয়েছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে। এই মামলায় নিজামসহ তাপস ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতাকর্মীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নিজাম উদ্দিন।
সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত নিজাম হোয়াটস অ্যাপে প্রতিবেদককে বলেন, সাধারণ ব্যবসায়ীরাই চান না যে প্রশাসন বসুক। এ জন্যই তারা বাধা দিচ্ছেন। অন্যায়ভাবে ওপরমহলের চাপে প্রভাবিত হয়ে অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয় মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এ বিষয়ে উপপরিচালক রকনুল হক অবগত আছেন। তাছাড়া প্রশাসক নিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে রিট করলে আমাদের পক্ষে রায় এসেছিল। তবে আমাদের প্রতিপক্ষ সেই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়েছে। আর যেহেতু মার্কেটের সভাপতি ছিলাম, তাই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয়ের বিরুদ্ধে নিজামের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপপরিচালক রকনুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে ফোন কেটে দেন। দ্বিতীয় দফা ফোন করা হলেও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ফোন কেটে দেন।
অন্যদিকে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসীন উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, প্রশাসকের নিয়োগের ওপর স্থগিতাদেশ এসেছে বলে শুনেছিলাম। সেই স্থগিতাদেশ পরে বাতিল হয় বলেও শুনেছি। এ বিষয়ে আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা না আসায় আমাদের পক্ষ থেকে করার কিছু নেই। জিডির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মোহসীন উদ্দিন বলেন, ফৌজদারি অপরাধ না হওয়ায় কোনো তদন্ত করা বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর নিজাম উদ্দিনকে মামলার এজাহার থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বাদীর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে যে আবেদন এসেছে, সেখানে তার নাম ছিল না। এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে মনির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পরে কথা বলবেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি। সন্ধ্যায় তাকে আবারও ফোন করা হলে ফোন ধরেননি। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :