ঢাকা শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর, ২০২৪

তিন বছরে সিএমএসএফ’র ৩২৩ বৈঠক!

রহিম শেখ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৪, ০৪:১৩ পিএম

তিন বছরে সিএমএসএফ’র ৩২৩ বৈঠক!

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে ২০২১ সালে চালু করা হয় ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ)। উদ্দেশ্য ছিল বাজারের যেকোনো অস্থিতিশীল অবস্থাতে শেয়ার কেনাবেচা করে তারল্য নিশ্চিত করা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। অন্যান্য দেশের একই ধরনের তহবিলের মতো বাজারকে স্থিতিশীল করতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি সিএমএসএফ। বরং এর পর্ষদ (বোর্ড) পুঁজিবাজারে বাস্তব আর্থিক হস্তক্ষেপের পদক্ষেপ নেওয়ার চেয়ে রেকর্ড গড়েছে সভা করে।

তিন বছরে ৩২৩টি বৈঠক করেছেন পর্ষদ সদস্যরা। যেখানে অংশগ্রহণকারীদের সম্মানী বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি এক বছরে ১০০টির বেশি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসবে সম্মানীর হারও কম না। যেখানে প্রতি বৈঠক বাবদ কমিটির সদস্যদের জনপ্রতি সম্মানী ছিল ৮ হাজার টাকা। একের পর এক সভা আর সেখানে উপস্থিতির সম্মানী আদায়ের পাশাপাশি সিএমএসএফের পরিচালনা পর্ষদ ১ কোটি ৫২ লাখ টাকায় দুটি গাড়ি (কার) কিনেছে। আবার অফিস সংস্কারের জন্য ব্যয় করেছে প্রায় ৫ কোটি টাকা।

গত ৫ আগস্টের পর বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই পর্ষদ। সম্প্রতি ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, কোম্পানিগুলো ব্যাংকে পড়ে থাকা অবিতরণকৃত বা অবণ্টিত লভ্যাংশ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় সিএমএসএফ, যার ৪০ শতাংশ নগদ অর্থে সরাসরি শেয়ার কেনাবেচা করা যাবে। কিন্তু, তিন বছর অতিবাহিত হলেও ফান্ড গঠনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আইনগত সমস্যার সমাধান হয়নি। অথচ বিশে^র বহু দেশে আর্থিক সংকট এবং পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে এ রকম ফান্ডগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যেমন- ১৯৯২ সালে হর্ষদ মেহতা কেলেঙ্কারির ফলে শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের পর ভারতীয় পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়। আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য, নিয়ন্ত্রক সংস্থা- এসইবিআই বা সেবি ইনভেস্টরস প্রটেকশন অ্যান্ড এডুকেশন ফান্ডের ভূমিকা বাড়িয়েছে। এই তহবিল প্রতারিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে এবং বাজার সচেতনতা তৈরি ও পুঁজিবাজার সম্পর্কে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শিক্ষার উন্নতির জন্য তৈরি করা হয়। বাজারে খুচরা বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে আবারও উৎসাহিত করে এই উদ্যোগ এবং বাজারকে স্থিতিশীল করতে ভূমিকা রাখে।

২০০৮ সালের আর্থিক সংকটকালে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনার অধীন এক্সচেঞ্জ স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডকে (ইএসএফ) বাজারে তারল্য বা নগদ অর্থ জোগান দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা প্রদান এবং পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ইএসএফকে ব্যবহার করা হয়েছিল, যদিও এর প্রাথমিক কাজ ছিল বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় বাজারকে স্থিতিশীল করা। ২০১৫ সালে একটি বড় ধসের কবলে পড়ে চীনের পুঁজিবাজার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যেখানে শেয়ারদরের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পতন হয়। ব্রোকারেজ সংস্থাগুলো বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ না দিতে পারায় সিকিউরিটিজ ইনভেস্টরস প্রটেকস্বয়ং ফান্ড (এসআইপিএফ) রয়েছে চীনে। এই ফান্ডকেই তখন শেয়ার কিনে বাজারের ধস ঠেকানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। এসআইপিএফ প্রধান প্রধান কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে বাজারে হস্তক্ষেপ করে, যা শেয়ারদরকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত এই ফান্ডের আকার বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকায়। যেখান থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানÑ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ- আইসিবিকে ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া, ৫০ কোটি টাকা দিয়ে একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড চালু করা ছাড়া বাজার স্থিতিশীলতায় সিএমএসএফ’র ভূমিকা নেই। আইসিবি সেই টাকা ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। তবে বাজারের সার্বিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব ছিল ন্যূনতম।

২০২১ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি এই ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিগুলোর কাছে জমা অবণ্টিত লভ্যাংশ, বোনাস ও আইপিও সাবস্ক্রিপশনের অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং তার থেকেও বেশিকিছু করার উদ্দেশ্য থেকে। ফান্ড গঠনের অন্যতম ম্যান্ডেট ছিলÑ নগদ টাকার ১০ শতাংশ টাকা এফডিআর, ৪০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ (শেয়ার কেনাবেচা) ও ৫০ শতাংশ ফান্ড বাজারের অংশীজনদের (রিফাইন্যান্সিং মার্জিন) ঋণ হিসাবে দিতে হবে। এরপর বাকি ১০ শতাংশ স্থায়ী আমানত, সরকারি সঞ্চয়পত্র ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে সংরক্ষণ করতে হবে। ১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকার মধ্যে নগদ লভ্যাংশ প্রায় ৬৩২ কোটি টাকা আর স্টক ডিভিডেন্ট প্রায় ৯১৩ কোটি টাকা। ১১ সদস্যের বোর্ডের বাইরে ফান্ডটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় প্রায় এক ডজনের বেশি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির কোনোটির সদস্য ৪ জন, আবার কোনোটির সদস্য ১০ জনের বেশি।

সিএমএসএফ এর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ৬৩ বোর্ড মিটিং হয়েছে, আর অন্যান্য কমিটির সভা হয়েছে ২৬০টি। অর্থাৎ, প্রায় প্রতিদিনই করা হয়েছে কোনো না কোনো মিটিং, যেখান থেকে বছরে কোটি টাকা সম্মানী নিয়েছেন সিএমএসএফ’র বোর্ড সদস্য ও অন্যান্য কমিটির সদস্যরা। এসব সভায় কেবল বোর্ড সদস্যরাই নয়, বোর্ড সদস্যের বাইরেও চেয়্যারম্যানের ঘনিষ্ঠজনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারাও প্রতি মিটিংয়ে ৮ হাজার করে সম্মানী পেয়েছেন।

আইসিবির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, শুরু থেকেই এই স্থিতিস্থাপক ফান্ড গঠনের বিষয়টি বিতর্কিত ছিল। অবণ্টিত লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের টাকা, যেগুলো সংগ্রহের পরে এই ফান্ডের তার ম্যান্ডেট অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, অর্থ সংগ্রহের পরে ফান্ড যদি ম্যান্ডেট অনুযায়ী পরিচালিত না হয়, সেক্ষেত্রে কমিশন বিষয়টির তদন্ত করতে পারে। যেহেতু এখানে জনগণের অর্থ রয়েছে, তাই ফান্ডকে অবশ্যই ম্যান্ডেট মেনে চলতে হবে। 
৬ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সরকার: ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটি গঠন করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেছেন সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী লুতফুল হাসান।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গঠিত কমিটিতে রয়েছে- অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ আহ্বায়ক, অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ঋণ ব্যবস্থাপনা সদস্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক সদস্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের উপযুক্ত প্রতিনিধি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য সচিব।

কমিটি সিএমএসএফ তহবিলের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণ, তহবিল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন; এবং বিবিধ কার্যাবলি নির্ধারণ করবে।

আরবি/এফআই

Link copied!