বাবা ও মেয়ের কবজায় ছিল দেড় দশক ধরে কুমিল্লার মানুষ। কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। নিজেকে ‘কুমিল্লার অভিভাবক’ পরিচয় দেওয়া এই নেতা প্রভাব খাটিয়ে নিজের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনাকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র বানান।
২০০৮ সাল থেকে কুমিল্লায় শুরু হয় বাহার পরিবারের রাজত্ব। বাহার নিজে, স্ত্রী, মেয়েজামাই, ভাই, ভাতিজার নামে গাড়ি, বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাটসহ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারও করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের জন্য বাহার পরিবারের নামে তিনটি মামলা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র-জনতার হত্যাযজ্ঞে নির্দেশদাতাও ছিলেন বাবা-মেয়ে। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে।
বর্তমানে দুজনই আত্মগোপনে রয়েছেন। গুঞ্জন রয়েছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন, সেখানে বসেই ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন।
জানা গেছে, চারবারের এমপি বাহারের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল কুমিল্লায়। জেলার রাজনীতি থেকে সন্ত্রাস- সবই ছিল বাহার ও তার মেয়ে সূচনার নিয়ন্ত্রণে। বাবা-মেয়ের ইশারা ছাড়া কুমিল্লার গাছের পাতাও নড়ত না বলে গুঞ্জন রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাকে করা হতো নিষ্ঠুর নির্যাতন। তার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষ।
গত দেড় দশকে টেন্ডারবাজি, গোমতী নদীর মাটি কাটা, পাহাড় কাটাসহ নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। গত বছরের ৫ আগস্ট বাহার-সূচনার নগরীর মুন্সেফবাড়ী এলাকায় অবস্থিত বাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দিয়ে এবং লুটপাটের পর বিক্ষুব্ধ জনতার বক্তব্য ছিল, ‘কুমিল্লার ফেরাউন থেকে আল্লাহ আমাদের মুক্ত করেছেন।’ আবার অনেকেই বলতে থাকেন, ‘জালিম বাহারের হাত থেকে কুমিল্লা মুক্ত হয়েছে।
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর কুমিল্লার সাধারণ মানুষ সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘কোথায় গেল কুমিল্লার অভিভাবক!’, ‘এমপি বাহার এখন কোথায়!’ ‘এক বাপের মেয়ে দেশটা খাইছে আর বাপ-বেটি মিলে কুমিল্লাটারে শেষ করছে’।
রাজধানীর উত্তরায় বাহারসহ তার মেয়ে ও স্ত্রীর নামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। সিঙ্গাপুরে কিনেছেন দুটি বাড়ি, স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে রয়েছে প্রচুর স্বর্ণালংকার। বিলাসবহুল গাড়ি ছাড়া কখনো চলাফেরা করতেন না। কোটি টাকা মূল্যের রয়েছে চারটি গাড়ি। তার তিন মেয়ে চলাফেরা করতেন কোটি টাকার গাড়িতে।
ব্যবসা-বাণিজ্য, দখলবাজি, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে শত শত অস্ত্রধারী নিয়ে এমপি বাহার বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতেন। পরিবেশ বন অধিদপ্তরের এক নারী কর্মকর্তাকেও দিয়েছিলেন হত্যার হুমকি। বাহার বাহিনী কুমিল্লা ক্লাবকে টর্চার ক্লাবে পরিণত করেছিলেন। যদিও ক্লাব পুড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ ছাত্র-জনতা।
সাবেক এমপি বাহার ও মেয়ে সূচনা বর্তমানে কলকাতায় এক রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়ে রয়েছেন। বাহারের কাছে কূটনৈতিক পাসপোর্ট থাকলেও তা এরই মধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। বাহারের কূটনৈতিক পাসপোর্টে ও মেয়ে সূচির সাধারণ পাসপোর্টে কানাডার ভিসা রয়েছে।
বাহার চোখের অপারেশনের অজুহাতে গত ১৫ জুলাই ঢাকায় চলে যান। এরপর আর কুমিল্লায় ফেরেননি। রাজধানীর উত্তরার বাসভবন থেকেই আন্দোলন দমানোর নির্দেশ দেন নেতাকর্মীদের। তার সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন তার মেয়ে মেয়র সূচনা।
গত ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির দিন কুমিল্লার কোটবাড়ী বিশ্বরোড এলাকায় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের। সেদিন মহানগর থেকে শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে টমছমব্রিজ-কোটবাড়ী সড়কে অবস্থান নেন সাবেক মেয়র সূচনা।
এ সময় সড়কে সড়কে নিপীড়ন চালানো হয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের। সর্বশেষ গত ৩ আগস্ট কুমিল্লা নগরীতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচিতে ব্যাপক তাণ্ডব চালান মহানগর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা।
২০০৮ সাল থেকে বাহার ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন ক্যাডার ও সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি। দমন-নিপীড়ন শুরু করেন সারা কুমিল্লায়। জেলার সব সেক্টরেই এমপি বাহারের প্রভাব ছিল।
কুমিল্লা সদরের এমপি হলেও পুরো জেলায় বাহার পরিবারের কথাই ছিল শেষ কথা। জেলার ১১টি সংসদীয় আসনের বেশির ভাগ সংসদ সদস্য ছিলেন বাহারের বলয়ে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জেলার বেশির ভাগ উপজেলাতেই ছিল বাহারের আধিপত্য।
গত বছরের ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনাকে বানিয়েছেন সিটি মেয়র। এক কথায় বলতে গেলে, গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাহারই ছিলেন কুমিল্লার ‘একমাত্র রাজা’। তার ভয়ে তটস্থ ছিলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
কুমিল্লার সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল বাহারের কবজায়। সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, ফ্যাসিলিটিস ডিপার্টমেন্ট, সিটি করপোরেশন, জনস্বাস্থ্যসহ সব বিভাগ ছিল বাহারের দখলে। কুমিল্লায় কোনো ঠিকাদার দরপত্র দাখিল করার সাহস পেতেন না। বাহারের লোকজনের বাইরে কেউ টেন্ডার জমা দিতেন না। কুমিল্লার অন্য ১০ সংসদ সদস্যের কেউ তার বিরুদ্ধে প্রশ্নও তুলতেন না।
২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বাহার ব্যাংক ঋণের কারণে নির্বাচন করতে পারছিলেন না। ওই সময় তিনি ছিলেন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি।
তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চাঁদা তুলে বাহারের ব্যাংক ঋণ পুনঃতপশিল করে তাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী সময়ে সেই বাহার হন বিপুল সম্পদের মালিক। বিত্তবৈভবের অভাব ছিল না।
অল্প দিনের ব্যবধানে তিনি সোনালী স্কয়ার, কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেট, ঢাকার উত্তরায় বাড়ি এবং নাইস পাওয়ার অ্যান্ড আইটি লিমিটেড, সোনালি সুইটস লিমিটেড, নাসুয়া অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, মাইন্ড মুভবার লিমিটেড, এ সিক্স লিমিটেড, এমবি টেক্সটাইল অ্যান্ড ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং গোমতী ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের মতো অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
বাহার নেটওয়ার্কে যারা: দুদক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাহার ঘনিষ্ঠ সহযোগী কামাল হোসেনের মাধ্যমে কুমিল্লার সব দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করতেন। অনিয়ম ও দুর্নীতি করে শতকোটি টাকার মালিক কামালও। মনিরুল হক সাজু কামালের সঙ্গে থেকে তিনিও হয়েছেন বিপুল টাকার মালিক।
সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়া উপজেলায় যেকোনো কাজের জন্য আগে আমিনুলকে ম্যানেজ করতে হতো। কুমিল্লা যুবলীগের আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতেন।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুল্লাহ খোকন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা আদায় ও জমি দখল করতেন।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টু ও সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান পিয়াস টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্যানেল মেয়র হাবিবুল আল শাহরিয়ার সাদী পিএস কামালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখল চালু রাখেন।
পিএস কামালের সঙ্গে মিলে বাহারের ব্যাংকিং বিষয়ে লজিস্টিক সাপোর্ট দিতেন সোনালী ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হাসান খসরু। জাল কাগজপত্র দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ, বিদেশে টাকা পাচারসহ নানা অনিয়মের মূল হোতা এই হাসান খসরু। রিভারভিউ সিএনজি স্টেশনের মালিক ফারুক হোসেন কামালের বিশ্বস্ত সহচর। খাসজমি, হিন্দু সম্পত্তি দখলবাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
এই চক্র জমি অবৈধ দখল করে বিক্রি করে দেয়। সিবিএ নেতা ও সোনালী ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসান মাহমুদ সুমন পিএস কামালের সঙ্গে মিলে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন ঋণ পাশ করিয়ে দেন বাহারকে। দেশের বাইরে টাকা পাচার করার বিষয়ে বাহার ও কামালকে সহযোগিতা করতেন মাহমুদ।
সাবেক মন্ত্রী তাজুলের শ্যালক ও লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী বাহার ও তাজুলের ছত্রছায়ায় থেকে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন। টেন্ডার-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, দখলদারিত্ব সবই চলত তার তত্ত্বাবধানে। প্যানেল মেয়র মঞ্জুর কাদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
হজ এজেন্সি বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি তছলিম বাহারের সঙ্গে মিলে টেন্ডার-বাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্য, দখলবাণিজ্য করতেন। বাহারের ভাতিজা হাবিবুর রহমান আল সাদি কামালের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছেন।
এদিকে, বাহারের মেয়ে সূচনার বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত সোমবার দুদক সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার, স্ত্রী মেহেরুন্নেছা, মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসীন বাহারের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছে।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, সাবেক এমপি বাহার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ৬৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকারও বেশি সম্পদ অর্জন করেছেন। এছাড়া ২৯টি ব্যাংক হিসাবে ২৫৮ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন করেছেন তিনি।
প্রথম মামলায় বাহারের বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৭ (১) ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫-এর (২) ধারা ও মানি লন্ডারিং আইন, ২০১২-এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় মামলা হয়েছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় মামলায় মেয়র তাহসীন বাহারকে আসামি করা হয়েছে।
তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের অসংগতিপূর্ণ ৩ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। আর তার ১৬টি ব্যাংক হিসাবে ৪২ কোটি ৫৮ লাখ টাকাও বেশি লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
তৃতীয় মামলায় সাবেক এমপি বাহার ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা আসামি হয়েছেন। একজন গৃহিণী হয়ে তার স্বামীর অবৈধ সম্পদ বৈধ করার চেষ্টার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুদক। তার বিরুদ্ধে ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকারও বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এছাড়া আসামি বাহারের দুই মেয়ে যথাক্রমে আয়মান বাহার ও আজিজা বাহারের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক। তথ্যের যথার্থতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে তাদের প্রতি দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৬(১) ধারা মোতাবেক আলাদা সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারির সুপারিশ গৃহীত হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :