ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫

জীবনযাত্রায় খরচের ফাঁদ

রহিম শেখ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম

জীবনযাত্রায় খরচের ফাঁদ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জনগণের খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার পণ্যমূল্য কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর চেষ্টা চালাবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে স্বস্তি দেওয়ার পরিবর্তে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের পাশাপাশি আয়করের আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের ঋণের শর্ত মানতে অসময়ে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে ৪৩ পণ্য ও সেবায়। ভ্যাটের হার বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়বে খুবই সামান্য, অথচ আরও চাপে পড়বে জীবনযাপন। ভ্যাট বাড়ানো হলে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পর্যটন, পোশাক-পরিচ্ছদ কেনাকাটায় খরচ বাড়বে ভোক্তাদের। একই সঙ্গে মোটরবাইক, ফ্রিজ, এসি উৎপাদনকারীদের কর দ্বিগুণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। পাশাপাশি মোবাইল ফোন-সেবায় সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। ফলে জীবনযাত্রায় একধরনের খরচের ফাঁদে পড়বে সাধারণ মানুষ। তাই ভ্যাট ও করের হার না বাড়িয়ে আয়কর ও ভ্যাটদাতার সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারকে দেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে করছাড় কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর অংশ হিসেবে ভ্যাটহার যৌক্তিক করার কথা বলেছে। আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটির বেশি। এই অর্থ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার (৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা) সঙ্গে যোগ হবে। বাজেট প্রণয়নের সময় অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআরকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়। এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক নয় বলে এনবিআর থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। তার ওপর আইএমএফ আরও ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। সদ্য বিদায়ি বছরের ৪ ও ৫ ডিসেম্বর এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশে আইএমএফ মিশনের প্রধান জয়েন্দু দে। বৈঠকে আইএমএফ কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনার জন্য চাপ দেয়। একই সঙ্গে বাজেট পদক্ষেপের মাধ্যমে কর-জিডিপির অনুপাত আগের শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশের অতিরিক্ত আরও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেয়। এরই মধ্যে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনা হয়েছে। এসব সংশোধনীসহ মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে গত বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। খুব শিগগির তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে বলে জানা গেছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, আইএমএফের পরামর্শমতে মানুষের প্রতিদিন ব্যবহার্য ৪৩ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হলোÑ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ/সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল), বিমান টিকিট ইত্যাদি। ভ্যাট বাড়ানোর তালিকায় হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পর্যটন, পোশাক-পরিচ্ছদ কেনাকাটায় খরচ বাড়বে ভোক্তাদের।

তবে গত বৃহস্পতিবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের জন্য নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। তিনি দাবি করেন, পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ার ফলে নিত্যপণ্যের দামে কোনো বড় প্রভাব পড়বে না। 

এদিকে মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসর শিল্পের আয়কর বাড়িয়ে দিগুণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত মঙ্গলবার এক প্রজ্ঞাপনে এ ধরনের শিল্পের আয়ের ওপর ২০ শতাংশ কর নির্ধারণ করেছে; এতদিন যা ১০ শতাংশ ছিল।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আগামী ২০২৫-২৬ করবর্ষ থেকে নতুন হারে আয়কর ধার্য হবে; অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে এ ধরনের শিল্পের যে আয় হবে, তার ওপর এই বাড়তি কর দিতে হবে। এসব শিল্পকারখানা যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও উপকরণ আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিয়ে আসছে। এই করও বাড়ানোর কথা রয়েছে বলে এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন; সেটি বাড়ালে যেদিন থেকে বাড়াবে সেদিন থেকেই কার্যকর হয়ে যাবে। এসব শিল্প ২০২১ সাল থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে ২ শতাংশ এআইটি এবং আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর দেওয়ার সুবিধা পেয়ে আসছিল, যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকার কথা ছিল। সেই আদেশ বাতিল করে এখন নতুন করহার ধার্য করা হলো।

মোটরসাইকেল, এসি, রেফ্রিজারেটর ও কম্প্রেসর উৎপাদনকারী কোম্পানির ক্ষেত্রে বর্তমানে ২৫ শতাংশ ও সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে সাধারণ করপোরেট কর প্রযোজ্য। এই চার ধরনের পণ্যের আয়কর বাড়ানোর ফলে বাড়তি ১ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে বলে এনবিআর কর্মকর্তাদের ভাষ্য। এসি ও রেফ্রিজারেটর বাজারের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের চিফ মার্কেটিং অফিসার মোহাম্মদ মেসবাজ উদ্দিন বলেন, যে হারে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়াচ্ছে, তাতে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমছে, অন্যদিকে ক্রমাগত কর বাড়ানোর কারণে পণ্যমূল্যও বাড়ছে। ফলে আমাদের বিক্রিও কমতির দিকে। নতুন করে কর বাড়ালে তা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং বাজার আরও সংকুচিত হবে।

গত শনিবার এনবিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জনস্বার্থে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের শুল্ক করহারে ব্যাপক ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি, এসডিজি বাস্তবায়নে ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি ও হার যৌক্তিকীকরণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

এনবিআর বলছে, ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এবং আবগারি শুল্কের হার ও পরিমাণ ‘যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে’ রাজস্ব আহরণ বাড়াতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। মূল্য সংযোজন করের পাশাপাশি আয়করের ক্ষেত্রেও করের আওতা বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। আয়কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার ধারাবাহিকতায় আয়কর অব্যাহতির বিধান বাতিল ও সংশোধনের কার্যক্রমও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এদিকে ফের খরচ বাড়ছে মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে। এবার এই সেবার ওপর ৩ শতাংশ সম্পূরক কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা সরকারের পক্ষ থেকে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সময় এ নিয়ে  প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। গত মঙ্গলবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল ফোন সেবায় সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী বর্তমানে মোবাইল ফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ দিতে হয় ২৮ দশমিক ১ টাকা, রেভিনিউ শেয়ার ও মিনিমাম ট্যাক্স দিতে হয় ৬ দশমিক ১ টাকা, পরোক্ষ কর দিতে হয় ২০ দশমিক ৪ টাকা। মানে গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সব মিলিয়ে কর দেন ৫৪ দশমিক ৬ টাকা।

তবে এখন সম্পূরক শুল্ক যদি আরও ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়, তাহলে কর দিতে হবে ৫৬ দশমিক ৩ টাকা। এর মধ্যে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ কাটবে ২৯ দশমিক ৮ টাকা। রেভিনিউ শেয়ার ও মিনিমাম ট্যাক্স কাটবে ৬ দশমিক ১ টাকা, পরোক্ষ কর কাটবে ২০ দশমিক ৪ টাকা। ফলে গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সব মিলিয়ে কর দিতে হবে ৫৬ দশমিক ৩ টাকা। এতে করে গ্রাহক ১০০ টাকায় ব্যবহার করতে পারবেন মাত্র ৪৪-৪৫ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সময় প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এর ফলে মোবাইল ফোন সেবার ওপরে ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়বে।

সে হিসাবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকার ভ্যাট হিসেবে কেটে নেবে ৫৬ টাকা। এর মানে হলো, ভয়েস কলের সার্ভিস ব্যবহারের জন্য গ্রাহকদের ট্যাক্সসহ ৫৬ টাকার বেশি দিতে হবে, যা আগের তুলনায় বেশি। ভয়েস কল ও ইন্টারনেট ডাটায় নতুন করে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক আচরণ বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, এনবিআরের ওপর ফ্যাসিবাদী সরকারের আত্মা ভর করেছে। সেজন্যই নতুন করে গ্রাহকদের ওপর অনৈতিকভাবে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে।

আমরা মনে করি, এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত একমাত্র তারাই নিতে পারে, যাদের ওপর বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের ছায়া রয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবায় আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় তলানিতে আছি, কিন্তু ভ্যাটের ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানে। যেখানে দেশের এখনো ৪৮ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সেবার বাইরে আছে, সেখানে নতুন করে এই উচ্চ কর নাগরিকদের ইন্টারনেট-সেবা থেকে বিমুখ করবে। এমন সিদ্ধান্ত নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি করবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!