হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় আদালতপাড়ায় কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত। পরিবেশ সংরক্ষণসহ জনস্বার্থে ৩৫০-এর বেশি মামলা করেছেন তিনি। মানবাধিকার, আইনের শাসনসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এফ এ শাহেদ
রূপালী বাংলাদেশ: কেমন আছেন আপনি?
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: জি, ভালো আছি।
রূপালী বাংলাদেশ: জনস্বার্থে কাজ করছেন দীর্ঘ বছর ধরে, বিপুল এই কর্মযজ্ঞের প্রাণশক্তির উৎস কী?
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: দেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও দোয়া আমার বিপুল প্রাণশক্তির মূল উৎস। জনস্বার্থে কাজের যে যাত্রাটি শুরু হয়, তা মূলত মর্মান্তিক একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। একবার ঢাকা জজ কোর্ট থেকে এক আত্মীয়ের বাচ্চা মারা যাওয়ার সংবাদ পেয়ে জানাজায় অংশ নিতে আজিমপুর রওনা হই। কোরবানির সময় ছিল তখন। রিকশা নিয়ে কোর্ট থেকে গুলিস্তান হয়ে বুয়েটের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমার। তবে, রাস্তার ওপর গরুর হাটের কারণে জ্যাম থাকায় ৩ ঘণ্টায়ও পৌঁছতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্টে মনে একটি প্রশ্ন এলো, আইন অনুযায়ী চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে এভাবে গরুর হাট হতে পারে না। রাস্তায় গরুর হাট বন্ধ, একই সাথে ডিসেম্বর মাসে সিভিল ভ্যাকেশন কোর্ট প্রতিষ্ঠার জন্য জনস্বার্থে রিট পিটিশন দায়ের করি। রায় আমার ও জনস্বার্থের পক্ষে এলো। সেই শুরু হলো ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) কাজ।
রূপালী বাংলাদেশ: জনস্বার্থে কাজ করতে গিয়ে অনেক বড় শক্তির বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হয়েছে, কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: জনস্বার্থে অনেক বড় বড় শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে অবৈধ ওষুধ উৎপাদনের ‘ত্রুটি’ নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছি। ভেজাল খাদ্য বন্ধ, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অধিকার নিশ্চিত, পরিবেশদূষণ বন্ধ করা, প্রত্নতত্ত্ব সুরক্ষা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার নিশ্চিত করা, পুলিশ হেফাজতে হত্যা, নারী নির্যাতন, নদী রক্ষা, পাহাড়-খাল-বিল রক্ষা, সরকারি সম্পত্তি রক্ষাসহ নানা বিষয়ে মামলা করেছি।
যেখানে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত লেগেছে। তারা নানাভাবে আমাকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিষয়গুলো বন্ধ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছে। তবে আমি সেগুলো গ্রহণ না করায় তারা আমাকে বিভিন্ন সময় তিনবার হত্যার হুমকি দিয়েছে।
তবে আমি থেমে যাইনি। মুসলিম হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। জন্ম নিয়েছি মৃত্যুর জন্য, সুতরাং যত দিন বেঁচে থাকব, মানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই চলবে।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট, দেশে পরিবর্তিত সময়ে বর্তমান আইনের শাসন কেমন দেখেন?
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: আইনের শাসন বলতে কী বোঝায় সেটা আমাদের বুঝতে হবে। ধরুন, রাস্তায় আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, তার একটি নির্দিষ্ট আইন আছে। সেই আইনের ব্যত্যয় হলে, সেটা যে বা যার দ্বারা হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাকে সেই আইন মানতে হবে। কেউ অন্যায় করলে, তার বিরুদ্ধে মামলা হবে, গ্র্রেপ্তার হবে। আইন তার নির্দিষ্ট গতিতে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এগুলো যদি সঠিকভাবে চলে, তবেই বলা যায় আইনের শাসন বিদ্যমান।
যেখানে জোর-জবরদস্তি থাকবে, আইন না মানার প্রবণতা থাকবে, সেখানে তো আইনের শাসন থাকে না। সুতরাং বর্তমানে দেশে যে অবস্থা বিদ্যমান, সেখানে বলা যায় না যে সঠিকভাবে আইনের শাসন বিদ্যমান আছে।
রূপালী বাংলাদেশ: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে করণীয় কী?
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: দেশে ‘রুল অব ল’ (আইনের শাসন) প্রতিষ্ঠা করতে হলে ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্র) সচল থাকতে হবে। যেখানে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে মব-জাস্টিসের নামে মব-ভায়োলেন্স করার সুযোগ থাকবে না। কারণ, যে বা যারা মব-জাস্টিসের ভিকটিম হচ্ছে তারাও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। সুতরাং রুল অব ল প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে, স্বচ্ছ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে, পুলিশ হেফাজতে যেকোনো মব জাস্টিসের নামে আসামি হেনস্তার ঘটনা ঘটলে সেই দায়িত্বে থাকা পুলিশকেও আইনের আওতায় আনা হবে। তবেই হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আমরা দেখেছি পুলিশ হেফাজতে আসামিদের ইদানীং ছিনিয়ে নিয়ে মারপিট করা ও ডিম নিক্ষেপের মতো ঘটনা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান কাজ হলো সবার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশে গণতন্ত্র সচল রাখতে কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: গণতন্ত্র বলতে যেটি বোঝায়, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর সঠিকভাবে সেটা কখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে, চেষ্টা হয়েছে। গণতন্ত্র বলতে জনগণের যারা প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। তার জন্য ৫ বছর পর পর সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ ও ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ তার ভোটের অধিকারের মাধ্যমে যেন তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি আসতে হবে। ক্ষমতায় এসে কতটুকু ভালো কাজ করল না খারাপ করল, জনগণ তার বিচার করবে ভোটের মাধ্যমে। সুতরাং মোটা দাগে বলতে গেলে গণতন্ত্র সচল রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভোটের অধিকারের সাথে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।
বর্তমান সরকার মানুষের হারানো ভোটের অধিকার নিশ্চিতে কমিটি গঠন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন করতে পারে, যেখানে মানুষ তার হারানো ভোটের অধিকার ফিরে পায়। তাহলেই দেশে গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে বলে আশা করি।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনার জীবদ্দশায় বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষের জন্য কেমন পরিবেশ দেখতে চান?
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: আমি চাই শিক্ষাক্ষেত্রে অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হবে, প্রতিটি মানুষ তার শিক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত করতে পারবে। চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে, দেশের মেধা বাইরে পাচার হবে না, মেধার যথাযথ মূল্যয়ন করা এবং তাদের কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রতিটি মানুষ তার চিকিৎসাসেবা পাবে, যেন কোনো অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়। সর্বোপরি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, প্রতিটি মানুষ তার খারাপ কাজের জন্য শাস্তির আওতায় আসবে।
নদী দখল, শব্দ-বায়ুদূষণ বন্ধ হবে। মানুষ ভাতের সাথে সাথে তাদের ভোটের অধিকার পাবে। দেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকবে, যেখানে রাজনীতি থাকবে, তবে দুর্বৃত্তায়ন থাকবে না। সংসদ হবে আইন প্রণয়নের জায়গা, যার মাধ্যমে একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠন হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: ধন্যবাদ আপনাকে।
অ্যাড. মনজিল মোরসেদ: রূপালী বাংলাদেশ এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনার মতামত লিখুন :