ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক পিআরও মো. আবুল খায়ের

দীপু মনির ভাইকে নিয়ে গড়ে তোলেন লুটপাটের সাম্র্রাজ্য

মেহ্দী আজাদ মাসুম

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দীপু মনির ভাইকে নিয়ে গড়ে তোলেন লুটপাটের সাম্র্রাজ্য

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

*দুর্নীতি, অনিয়ম আর অপকর্মের ফিরিস্তি অনেক লম্বা

*সরকারের কোটি টাকায় বাবার নামে করেছেন কলেজ, স্ত্রীকে দিয়েছেন চাকরি


শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর-দাপুটে কর্মকর্তা ছিলেন আবুল খায়ের। এখন মন্ত্রণালয়ে না থাকলেও রয়ে গেছে তার দুর্নীতি, অনিয়ম আর অপকর্মের লম্বা ফিরিস্তি। আলোচনায় রয়েছে, প্রভাব খাটিয়ে ঊর্ধ্বতন-অধঃস্তনদের ওপর খবরদারি। থেকে গেছে তার নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের অর্থ ভাগাভাগির কেলেঙ্কারি ও অবৈধ আয়ে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের সাতকাহন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আবুল খায়েরকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য অধিদপ্তরে প্রত্যাহার করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এই সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তার (পিআরও) ক্ষমতার উৎসই ছিলেন সাবেক শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

দীপু মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন আবুল খায়ের। বিসিএস তথ্য ক্যাডারে একাধিক কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও নন ক্যাডার কর্মকর্তা আবুল খায়েরকে ২০১৮ সালে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিই তার মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পেয়ে দুদিন অফিস করা তথ্য কর্মকর্তা জাকির হোসেনের নিয়োগও বাতিল করে দেন তিনি। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়োগে প্রধান্য পেয়ে থাকেন।

এর আগে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আবুল খায়ের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পিআরও ছিলেন। কম সময়েই তিনি প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। সচিবালয়ে এ মন্ত্রণালয়ে পিআরও হিসেবে কাজের মধ্য দিয়ে আবুল খায়েরের হাতেখড়ি শুরু হয় ক্ষমতার অপব্যবহারের। এরপর আর তিনি থেমে থাকেননি। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিজের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা ইতিকে যোগ্যতা কমিয়ে চাকরি দেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরে। শিক্ষাগত যোগ্যতা কমিয়ে চাকরি দেওয়া সরকারি বিধি লঙ্ঘনের শামিল।

২০১৮ সালে ক্ষমতাধর মন্ত্রী দীপু মনির হাত ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার পর থেকে আবুল খায়ের হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অধিকারী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-বদলি, এমপিও, শিক্ষক নিয়োগ, ঠিকাদারি, বন্ধ থাকা বেতন পাইয়ে দেওয়াসহ সব কাজের ঘুষ-বাণিজ্যের সিংহভাগ মন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিয়ে দীপু পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। মন্ত্রণালয়ের সব কাজ এককভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য দীপু মনির আপন ভাই ডা. জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ টিপুর নেতৃত্বে গড়ে তুলেছিলেন একটি সিন্ডিকেট।

চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার, মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক প্রশাসন (বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ) শাহেদুল খবির চৌধুরী, চাঁদপুরে জনতার হাতে গণধোলাইয়ে নিহত বালুখেকোখ্যাত সেলিম চেয়ারম্যান ও আবুল খায়ের এই সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন।

সিন্ডিকেটে শিক্ষা বিটের তিনজন সাংবাদিকও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই সিন্ডিকেট টাকা সংগ্রহকারীর ভূমিকা পালন করত।

অভিযোগ রয়েছে, পিআরও খায়ের শিক্ষামন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের কোনো সংবাদ লিখতেন না। তিনি থাকতেন শুধু এই মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যসহ মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ডের ধান্দা নিয়ে। ব্রিফিং ও বিজ্ঞপ্তি লিখে দিতেন একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের সিনিয়র প্রতিবেদক। তাকে সহযোগিতা করতেন শিক্ষা বিটের আরও দুজন সাংবাদিক। অভিযোগ রয়েছে, এই তিন সাংবাদিক এবং পিআরও মিলে রাজশাহী আলিপুর মডেল কলেজের বকেয়া ২০ কোটি টাকা বেতনের চেক পাইয়ে দিয়ে নিজেরা ঘুষ হিসেবে হাতিয়ে নেন ২ কোটি টাকা। এই টাকার ৫০ লাখ নেন পিআরও।

বাকিটা তিন সাংবাদিক ভাগ করে নেন। এ নিয়ে তিনজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল, যা সচিবালয়ে শিক্ষা বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে চাউর ছিল।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আবুল খায়ের তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আব্দুল কাদেরের কাছ থেকে দীপু মনিকে দিতে হবে বলে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে শিক্ষা ভবনের সহকারী পরিচালকের (বেসরকারি কলেজ) লোভনীয় পদে বদলি করে আনেন। 

বেসরকারি কলেজে নিয়োগ, পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট ও এমপিওর কাজের ঘুষের অংশ বেইলি রোডের একটি দোকানে বসে তিনি গ্রহণ করতেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

কয়েকটি সূত্র জানায়, আবুল খায়ের অবৈধ আয়ের অর্থে তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে গড়ে তুলেছেন বিশাল কৃষি খামার। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় কোটি টাকার ফ্ল্যাট, কেরানীগঞ্জে জমি, মাওয়া রোডে প্লট, নামে বেনামে কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে রেখেছেন অবৈধ টাকা। সরকারি সফর ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ সফর করেছেন অসংখ্যবার।

২০২৪-এর ৫ জানুয়ারির আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পিআরও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন আবুল খায়ের।

অভিযোগ থেকে জানা যায়, আবুল খায়ের প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকায় অর্থাৎ উপজেলা সদরে সরকারের কোটি টাকা ব্যয়ে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ফজলূল হক টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

অপ্রতিরোধ্য এই পিআরওর আধিপত্য ছিল বিসিএস সরকারি কলেজের শিক্ষক বদলি ও পদোন্নতিতেও। সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন তিনি। স্ত্রীর নামেও নিয়েছেন সরকারি গাড়ি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আবুল খায়েরের মোবাইলে গতকাল সোয়া ৯টা পর্যন্ত একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত (শেষ ডিজিট ...৮৮৮) মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আরবি/জেডআর

Link copied!