বেশির ভাগ অংশের মালিকানা থাকা বেসরকারি শেয়ারহোল্ডারদের অবহিত না করেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় চালুর আশ্বাসে ২০১১ সালে সিলগালা করা হয় দাদা ম্যাচ ওয়ার্কস ও ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরি।
এরপর দীর্ঘ ১৩ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। যুগ পেরিয়ে গেলেও সরকারি সিদ্ধান্তহীনতা ও দীর্ঘসূত্রতায় নিজেরা তো চালু করতে পারেনি, বেসরকারি কোম্পানির কাছেও বুঝিয়ে দেয়নি শিল্প মন্ত্রণালয়।
ঐতিহ্যবাহী ম্যাচ (দেশলাই) ফ্যাক্টরি দুটির ৩১ একর বিশাল সম্ভাবনাময় জমি ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে আধুনিক ও সময়োপযোগী কোনো শিল্পকারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আবার তিন বছর আগে বেসরকারি শেয়ারহোল্ডারদের দেওয়া নতুন প্রকল্প প্রস্তাবের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
এমনকি সংরক্ষণ কিংবা দেখভালের দায়িত্বও পালন করেনি নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি কর্তৃপক্ষ। ফলে ঢাকার শ্যামপুরে ১৯ বছর ধরে অচল ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরির কোটি কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতি-আসবাব অকেজো হয়ে গেছে। আর ১৪ বছর ধরে বন্ধ থাকা খুলনার রূপসায় দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি গত চার বছর ধরে নিরাপত্তাহীনতায় অরক্ষিত থাকায় লুটপাট হয়ে গেছে দামি যত্রাংশসহ সব মালামাল। তবু হুঁশ ফেরেনি সরকারি কর্তৃপক্ষের।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের টানা অন্তত ১৫ দিনের অনুসন্ধানে এমন ভয়াবহ তথ্য মিলেছে। তবে সরকারি কর্তৃপক্ষের দাবি, এ ক্ষেত্রে তাদের দায় নেই, দীর্ঘসূত্রতা নেই।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে এলাকাবাসী ও সাবেক শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে অনুসন্ধানী টিম।
স্থানীয় বাসিন্দাসহ কারখানা দুটির সাবেক শ্রমিকরা জোর দাবি জানান, যেহেতু এক যুগের বেশি সময়ে সরকার কারখানা চালু করতে পারেনি, তাই দ্রুত বেসরকারি কোম্পানির কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হোক। কারণ এর ৭০ শতাংশ মালিকানাই বেসরকারি কোম্পানি ভাইয়া গ্রুপের। তাদের কাছে বাকি মাত্র ৩০ শতাংশ মালিকানাও হস্তান্তর করতে পারে সরকার। তারা মনে করেন, নদীর তীরবর্তী ওইসব জায়গায় নতুন করে গড়ে তোলা হোক যুগোপযোগী একাধিক বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এতে করে বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি হাজার হাজার বেকার যুবক ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে দেশের অর্থনীতিতে।
অনুসন্ধানকালে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একতরফাভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কারখানা দুটি চালুর বেআইনি ও অযৌক্তিক আশ্বাস এবং পরবর্তীতে আইসিটি পার্ক করার অবাস্তব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কারণ এগুলো বেসরকারি-সরকারি যৌথ মালিকানায় চলছিল। নথিপত্রে অধিকাংশ মালিকানা বেসরকারি কোম্পানির। তারপরও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী খুলনার মুন্নুজান সুফিয়ানসহ কতিপয় কথিত শ্রমিক নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে নতুন করে চালুর নামে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের এ সম্পদ দখলের পাঁয়তারা চালায়। এভাবে তাদের অপচেষ্টা ও বিগত সময়ে মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের অহেতুক সময় ক্ষেপণে ধ্বংস হয়ে গেছে এক সময়ের জনপ্রিয় দাদা ম্যাচ ওয়ার্কস ও ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ওই স্থানে নতুন আঙ্গিকে শিল্প-কারখানা চালুর দাবি জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও সাবেক শ্রমিকেরা। প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন দেশের একাধিক অর্থনীতিবিদও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা ম্যাচ ও দাদা ম্যাচ নামের ফ্যাক্টরি বা কারখানা দুটি ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৪ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির আওতায় এটি করা হয়। এই কোম্পানির ৭০ শতাংশের মালিকানা দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ভাইয়া গ্রুপের। আর বাকি ৩০ শতাংশের মালিকানা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি)। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের কদমতলী-শ্যামপুরের চাকদা এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। ১৯৫৫-৫৬ সালে ১৩ দশমিক ৭৮ একর জমির ওপর বেসরকারি উদ্যোগে কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির অবস্থান খুলনার রূপসা স্ট্র্যান্ড রোডে। এটিও বেসরকারি উদ্যোগে একই বছরে খুলনার রূপসা নদীর তীরে ১৭ দশমিক ৩৫ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠে। ঢাকা ম্যাচ ও খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করে সুইডিশ একটি কোম্পানি।
জানা যায়, কয়েক যুগ আগের পুরোনো মেশিনারিজসহ ১৯৯৩ সালে সুইডেনের কোম্পানিটি তাদের ৭০ শতাংশ মালিকানা বিক্রি করে দেয়, যা সাফ কবলামূলে কিনে নেয় ভাইয়া গ্রুপ। এরপর সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় চলে ম্যাচ কারখানাগুলো। পরিচালনা বোর্ডে বিসিআইসির দুজন পরিচালক ও বেসরকারি শেয়ারহোল্ডারদের মনোনীত পাঁচজন পরিচালক দ্বারা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। পুরোনো মেশিন নিয়ে চলতে গিয়ে উপর্যুপরি ও টানা লোকসানের মুখে ২০০৫ সালে ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যায়। একই কারণে ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে যায় খুলনাস্থ দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। পরে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়ে চলতি মূলধনের জন্য একাধিক আবেদন করেও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়। ২০১১ সালের মার্চ মাসে সিলগালা করে দেয় সরকারি কর্তৃপক্ষ। ওই বছরের ২১ মার্চ প্রথমে পুঁজি বৃদ্ধির জন্য রাইড শেয়ার ইস্যুর তথ্য চেয়ে কোম্পানির কাছে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। আবার একই দিন রহস্যজনকভাবে ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি সিলগালা করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সিলগালা করার পর থেকে কারখানা দুটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা ম্যাচের জায়গায় লজিস্টিক সাপোর্টসহ একটি আধুনিক জেটি নির্মাণ ও খুলনা ফ্যাক্টরিতে একটি আধুনিক ফয়েল প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি (মোড়কজাত) করার প্রকল্প প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বেসরকারি শেয়ারহোন্ডার কোম্পানি। ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দেওয়া এক চিঠিতে বিসিআইসিতে সেটি দাখিল করা হয়। সেই চিঠিতে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বরে দেওয়া চিঠির প্রস্তাব মোতাবেক দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা বলা হয়। এতে বেসরকারি শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানাধীন ৭০ শতাংশ শেয়ার সরকারকে গ্রহণ কিংবা সরকারি মালিকানাধীন ৩০ শতাংশ শেয়ার বেসরকারি শেয়ারহোল্ডারদের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়। এরপরও কেটে গেছে তিন বছর। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কিংবা কারখানা চালুর বিষয়ে কোনো বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি শিল্প মন্ত্রণালয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ম্যাচ ফ্যাক্টরি দুটির বিষয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনের পর তাদের প্রতিবেদন জমা দিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওই জায়গায় সময়োপযোগী কী করা যায়, সেটি ভাবতে হচ্ছে।
সচিব দাবি করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা নয়, সমস্যা সমাধানে দু’পক্ষকে নিয়ে কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। কেউ দায়িত্ব নিতে না চাওয়ায় ও একপর্যায়ে খুলনা জেলা প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় সেখানে সমস্যা দেখা দেয়। তবে কারখানা দুটি যৌথ মালিকানায়ই চলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে দাদা ম্যাচের নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনার সাবেক একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জেলা প্রশাসনের কথায় পুলিশ বাহিনী নিরাপত্তা দিবে না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব উল্লেখ করে শিল্প মন্ত্রণালয় লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাতে পারে। পরে সেখান থেকে নির্দেশ দেওয়া হলে পুলিশ প্রশাসন সেটি কার্যকর করবে। এ প্রসঙ্গে খুলনার বর্তমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক তারা ব্যবস্থা নেবেন। তবে স্থানীয় সূত্র বলছে, এখনো সেখানে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. মাসুদ খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রায় ১৪ বছর যাবৎ কারখানা দুটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও চালু করতে পারেনি। নিরাপত্তা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেছে। তাই বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেওয়া হোক। যাতে করে কোম্পানি কারখানা দুটিতে সময়োপযোগী একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে চলমান অচলাবস্থা নিরসনপূর্বক সমস্যার সমাধান করতে পারে।
খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির বিষয়ে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় নিরাপত্তাহীন রাখার কারণেই কারখানাটির সব মালামাল লুটপাট হয়ে গেছে। কোম্পানির কাছ থেকে বুঝে নিয়ে আবার কোম্পানিকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা আইনগত সাংঘর্ষিক।
মাসুদ খান আরও বলেন, তারা শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চান না। তারা মন্ত্রণালয়কে এটা আগেই জানিয়েছেন। কারণ, তাদের সঙ্গে কাজ করতে গেলে সামান্য সিদ্ধান্তের জন্যও বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতা তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতাই কারখানা দুটি (ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি) চালুকরণে বড় সমস্যা।
আপনার মতামত লিখুন :