ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি, ২০২৫

সম্ভাবনার দুয়ার খুললেও চাপে বিএনপি

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪, ১২:৫২ এএম

সম্ভাবনার দুয়ার খুললেও চাপে বিএনপি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গত ৫ আগস্টের পর পাল্টে গেছে বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল বিএনপি। গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি লাভবান দলটি এখন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত সাংগঠনিক শক্তি জোরদার করেছে। জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশক ধরে শাসনের অবসান ঘটে। এরই মধ্যে দেশ গঠনে জোরেশোরে কাজ করছে ক্ষমতায় যাওয়ার কাছাকাছি প্রধান দল বিএনপি।

তবে নির্বাচন ও ক্ষমতায় আসতে চ্যালেঞ্জ দেখছে দলটি। বিএনপির তৃণমূল, শীর্ষ নেতাদের ভাষ্য এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সচেতন মহল বলছে, ‘২০২৪ বিএনপির সম্ভাবনার দুয়ার খুললেও এখনো কঠিন পরীক্ষায় দলটি।

এদিকে বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিএনপির কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষমতায় যাওয়া প্রধান লক্ষ্য নয়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলটির চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং লাখোকোটি নেতাকর্মীর সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলোÑ রাষ্ট্রের কল্যাণ করা, গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার করা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। সে জন্য দরকার ধৈর্যের সাথে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের নীতির ওপর ভিত্তি করে চলা। খালেদার প্রেস উইং ও বিএনপির মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ইনশাআল্লাহ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশদরদী তারেক রহমান সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফল হবেন।

২০২৪ কেমন গেল বিএনপির: বছরের শুরুতে চরম চাপে থাকলেও শেষের দিকে ফর্মে চলে আসে বিএনপি। তবে এখনো নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। বিএনপিকে নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা বলছেন, বাংলা একটি প্রবাদ আছে ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার।’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে গেল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ক্ষেত্রে যেটা লাভবান হয়েছে।

হাসিনার পতনের পর শক্তিশালী হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বছরের শুরুতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের নানা ধরনের চাপ মোকাবিলা করতে হিমশিম খেয়েছে বিএনপি। আর বছরের শেষভাগে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে ক্ষমতার পতন হয়েছে দীর্ঘ ১৬ বছরের শেখ হাসিনা সরকারের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে দেশ গঠনের কাজে প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করছে বিএনপি। চলতি বছরের শুরুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি।

৫ আগস্টের পর রাতারাতি পাল্টে যায় বিএনপির ভাগ্য: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর রাতারাতি পাল্টে যায় বিএনপির ভাগ্য। ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে কারাগার থেকে মুক্তি পান দলটির কয়েক হাজার নেতাকর্মী। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান নেওয়া দলটির নেতাকর্মীরাও দেশে ফিরতে থাকেন। দলটির পছন্দের লোকজন দায়িত্ব পান রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। বলা যায়, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি। সব মিলিয়ে অসাধারণ ও অকল্পনীয় একটি বছর পার করছে দলটি।

দল গোছাতে নজর: আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপি নেতারা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হচ্ছে সভা-সমাবেশ। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এখন সংগঠন গুছিয়ে নিয়ে এসে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তবে বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফার রূপরেখা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

দলটির সামনে যে চ্যালেঞ্জ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন রকম এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বিএনপি। আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তাবনা ও দলীয় নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ এখন কঠিন সংকটে। এবারের নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় নামতে হতে পারে বিএনপিকে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল নিয়ে ইসলামী ফ্রন্ট এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সম্ভাব্য নতুন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলটিকে। একই সঙ্গে বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে হবে দেশকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দেশের সামরিক-বেসামরিক শক্তি ও সুশীল সমাজের সমর্থন আদায়ত্ত করতে হবে। সঙ্গে রয়েছে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে লাভবান বিএনপি: শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগবিরোধীদের দখলে চলে গেছে। ৫ আগস্টের পর বেশ দ্রুততার সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এ সব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।

খালেদা জিয়ার মুক্তি ও রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে সংশয়:  ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে কারাগারে পাঠানো হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শর্ত সাপেক্ষে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তারপর বিভিন্ন সময় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও শর্ত অনুযায়ী তাকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। প্রায় সাত বছর পর গত ৭ আগস্ট বিএনপির জনসভায় খালেদা জিয়ার ভিডিও রেকর্ডিংয়ের বক্তব্য প্রচার করা হয়। আর এক যুগ পর গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সশস্ত্র বাহিনী দিবসে যোগ দেন তিনি। তবে তার শারীরিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয় এবং নানা ধরনের সংশয় তৈরি হয়।

তারেক রহমানের ফেরা: আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকা অবস্থায় তারেক রহমানের বক্তব্য বা বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী একটি রিট দায়ের করেন। পরের দিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। 

তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য ও বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। গত বছরের আগস্টে রিট আবেদনকারী সম্পূরক আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৮ আগস্ট এক আদেশে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বক্তব্য, বিবৃতি, অডিও ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেন।

বাধাহীন পরিবেশে কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি:  ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত যেকোনো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া বিএনপির জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। অনেক সময় আবেদন করেও পাওয়া যেত না অনুমতি। আবার দেওয়া হলেও সেটা কর্মসূচি শুরুর এক কিংবা দুই ঘণ্টা আগে।

পাশাপাশি পুলিশের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করা, কর্মসূচির মাঝপথে হামলা হওয়ার ভয় ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেই হামলায় উল্টো আসামি করা হতো বিএনপির নেতাকর্মীদের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির সেই অবস্থা কেটে গেছে। এখন সারা দেশে বাধাহীন পরিবেশে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে দলটি।

হাসিনার পতনে লাভবান বিএনপি: বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতির বাঁকবদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সালে, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে। এসব গণঅভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। আরেকটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

তারেক রহমানের মামলা ও প্রচার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার : ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে তারেক রহমানের বক্তব্য বা বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি রিট করেন আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে তিনি পলাতক আসামি। পরের দিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। এতে তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য ও বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এই আদেশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।  এ ছাড়া ২০২৩ সালের  ২৮ আগস্ট এক আদেশে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বক্তব্য, বিবৃতি, অডিও ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেন।

জেল ও মুক্তি ছিল আলোচনায়: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মির্জা ফখরুল ও আমীর খসরুকে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের কর্মসূচির পরপর গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান তারা। প্রায় সাড়ে তিন মাস কারাগারে তারা বন্দি ছিলেন।  এ ছাড়া নানা অভিযোগ গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, শাহজাহান ওমর, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ শীর্ষস্থানীয় সব নেতার বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের হয়। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, জেল ও মুক্তির বিষয়টি ছিল ২০২৪ সালের বড় আলোচনা।

৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জন: চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির ৩৫ সিনিয়র নেতাকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এ ছাড়া মধ্যম সারি ও তৃণমূলের অন্তত ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপি দেশবাসীকে নির্বাচনে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ৬ জানুয়ারি ভোর ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করে। এরপর ১১ জানুয়ারি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে দীর্ঘ ৭৫ দিন বন্ধ থাকার পর মূল ফটকের তালা ভেঙে প্রবেশ করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জন ও ৩৫ সিনিয়র নেতাকে কারাবন্দির ঘটনাটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

ভারতীয় পণ্য বয়কটে বিএনপির সমর্থন: ভারতীয় পণ্য বয়কট বা এই প্রচারাভিযানে সমর্থন দেয় বিএনপি। এ ছাড়া এই কর্মসূচিতে ৬৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটও সমর্থন দেয়। মূলত বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে এমন অভিযোগে নির্বাচনের পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বয়কট বা ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা। ‘ইন্ডিয়া আউট’ কার্যক্রমে সমর্থন দিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আস্থার সৃষ্টি করে দলটি।

বিএনপি ভাঙার গুঞ্জন: গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বিএনপি ভাঙার তৎপরতা ছিল। তাতে কোনো মহলই সফল হয়নি। নানা চাপ ও প্রলোভন থাকার পরও ‘দল ভাঙার প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা যায়নি। দল ভাঙার তৎপরতার অংশ হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার, মামলা এবং কয়েক শ নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়।

নেতাদের ভোটে নিতে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপি নামে কিংস পার্টি গঠন করা হয়। এতেও সাড়া মেলেনি। শুধু ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, একরামুজ্জামান ও শাহ আবু জাফর ছাড়া আর কাউকে দল থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়।

কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন:  ৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দেয় বিএনপি। পরে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। একের পর এক কর্মসূচি দেন।

আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয় বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারা দেশ যখন উত্তাল, তখন সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক আসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনে সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অংশ নেওয়ার নির্দেশনা দেন।

চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বিএনপি: আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তাবনা ও দলীয় নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় জামায়াতে ইসলামীসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সম্ভাব্য নতুন দলের মুখোমুখি হতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে হবে দেশকে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দেশের মানুষের মাথার ওপর এক ধরনের জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালানোর পর মানুষ স্বস্তিতে ফিরেছে। তবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত শতভাগ সাফল্য আসবে না। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, ‘১৬ বছরে আওয়ামী লীগ দেশের প্রতিটি সেক্টর ধ্বংস করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আগামীতে জনগণের ভোটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে বিএনপিকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তবে বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জনগণের স্বপ্ন পূর্ণ করে আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, ১৫ বছরের স্বৈরশাসকের দোসররা এখনো দেশের প্রতিটি সেক্টরে ঘাপটিমেরে রয়েছে। এদের চিরতরে বিদায় করতে না পারলে প্রকৃত শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। তিনি বলেন, বিএনপির দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ৫ আগস্ট হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আওয়ামী লীগ দেশের প্রতিটি সেক্টর ধ্বংস করে দিয়েছে এমন মন্তব্য করে  বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক সাফজয়ী ফুটবলার আমিনুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বে সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে একটি জবাবদিহিমূলক সরকার গঠন করে আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!