ঢাকা রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

কমিশন সিন্ডিকেটে সর্বনাশ

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪, ০১:৩৯ এএম

কমিশন সিন্ডিকেটে সর্বনাশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

২০০৯ সালের আগে কমিশন সিন্ডিকেট বাণিজ্য তেমন ছিল না। ২০১০ সালের পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিস্তার নেয়। বর্তমানে আমদানি পণ্যের বেশিরভাগ মুনাফা অদৃশ্যভাবে চুষে নিচ্ছে সেই কমিশন সিন্ডিকেট। ব্রাজিলে ৫৯-৬০ টাকা কেনা পণ্য চট্টগ্রাম পোর্টে আসার আগেই অদৃশ্য হাত ঘুরে প্রতি কেজিতে তার দাম উঠছে একশ টাকায়।

আমদানিকারক একাধিক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, জাহাজ ও পণ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে আমদানিকারকরাও তাদের কাছে অসহায়। তেল, চিনি, ডাল ও খেজুরবাহী বিশাল জাহাজ তাদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাদের কারণেই পণ্য সরবরাহে ঘাটতি, মূল্য নির্ধারণ ও দেশের বাজার স্থিতিশীল রাখা কঠিন। তবে এলসি খোলার পর নিরাপত্তার স্বার্থে প্রক্রিয়ার আড়ালে থাকে মূল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অধিকাংশ ব্যবসায়িক গ্রুপ বিভিন্ন কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিরতি দিয়েছে। তাদের মধ্যে আমদানিকারক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ।

অন্যদিকে সিটি গ্রুপ এবং মেঘনা গ্রুপ আমদানিনির্ভরতায় থেকে বেশি মুনাফায় তাদের পণ্য বাজারে ছাড়ছে। তবে আমদানিযোগ্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ কমায় মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ২০১০ সালের পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কমিশন সিন্ডিকেট বিস্তার নেয়। ব্যবসায়িক ও আওয়ামী লীগ দলীয় নেতারা আমদানি পণ্যের সমন্বিতভাবে মুনাফা পেতেই কমিশন বাণিজ্য শুরু করেছিলেন। শুরুতে কম মুনাফা করলেও এখন আমদানি পণ্যমূল্যের দ্বিগুণের বেশি মুনাফা করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই সিন্ডিকেট বাণিজ্য ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে সর্বনাশ বয়ে আনছে। দীর্ঘ সূত্রতার বিষয়টি সরকার অবগত হলেও কৌশলে সিন্ডিকেটের কাছে নতি স্বীকার করেছে।

কমিশন সিন্ডিকেট ভেঙে পণ্য পোর্টে আনা খুব কঠিন হলেও তা সম্ভব বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সততা এন্টারপ্রাইজের মো. খালেক। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারের শুল্ক অব্যাহতি দিয়ে দাম কমানো সম্ভব নয়। আগে ভেতরের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তবে আমরা পারব এবং আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহককে পণ্য দিতে পারব বলে আশা করছি।’

সরকারের সহযোগিতা চেয়ে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘৫৯-৬০ টাকায় কেনা পণ্য চট্টগ্রাম পোর্টে এনে সর্বোচ্চ আরও ৩০ মিলে কেজিতে ৯০ টাকা হবে। তার সঙ্গে পরিবহন খরচ এবং এজেন্ট ফি মিলে ১০৫-১১০ টাকায় গ্রাহককে পণ্য দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু বর্তমান বাজার দর মোটেও ঠিক নয়।’

আমদানিকারক গ্রুপ অব কোম্পানিগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যে কারণেই হোক এস আলম গ্রুপের ছয়টি কোম্পানি বন্ধ। গ্রুপের বাইরে অন্য কোম্পানিও চিনি, তেল, ডালসহ অন্যান্য পণ্য আনছে। কিন্তু মোট চাহিদার বিপরীতে তা কতটুকু? এস আলমসহ অন্য কোম্পানিগুলো সরবরাহ না করায় তার কুপ্রভাব পড়বে। কাজেই সরকারকে আরও ভাবতে হবে’ বলেন মো. আব্দুল খালেক। ‘আগামী ১৫ জানুয়ারি মধ্যে পণ্য আসবে’ বলেন তিনি।

শুল্ক অব্যাহতি দিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং গ্রাহক চাহিদা মেটানো সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলেন আমদানিকারক মীর মামুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘সরকার কমিশন সিন্ডিকেট কৌশল ভাঙতে পারলে দাম অর্ধেক হবে। অন্যদিকে, এনবিআর আমদানি শুল্ক কমিয়ে সাশ্রয়ী দামে গ্রাহককে যে পণ্য দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেই সুবিধা নিচ্ছে কিছু খুচরা ও আড়তদার ব্যবসায়ী। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে- জাহাজীকরণ মাল রয়েছে সমুদ্রে, পোর্টে আসার আগেই ৬০ টাকার মাল ১০০ টাকায় হাতবদল হয়ে যাচ্ছে। তাই শুল্ক অব্যাহতি দিয়ে সরকার গ্রাহককে কতটা সুবিধা দিতে পারবে তা ভাবনার বিষয়।’

ঢাকার বনানীতে সাক্ষাৎকালে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বিশেষত তেল আমদানি করছে সিটি গ্রুপ এবং মেঘনা গ্রুপ। অন্য ছোট কোম্পানিও আনছে, পরিমাণে কম। দুটি গ্রুপই এখন বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে এবং দিচ্ছে।’

সুপারিশ হিসেবে ঢাকার মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোদাববেরুল ইসলাম সাজু বলেন, ‘বাণিজ্যের এই বিষয়টি একেবাবে ভিন্ন। অন্ধকারে সাপ সারা ঘরে, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ এখানে জাহাজ এবং মালের নিরাপত্তার বিষয়।’ 

রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘জাহাজীকরণ মাল সমুদ্রে থাকতেই দ্বিগুণ মূল্যে কেনা বেচা শেষ। অন্তর্বর্তী সরকার এই দায় নেবে না, আর ভাঙতে পারবে বলেও মনে হয় না। কারণ ব্যবসায়ীরা কোনো দলের নয়। তবে গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকার ছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙা অসম্ভব।’

অদৃশ্যভাবেই হাতবদল
চাহিদার বিপরীতে ৬৫-৭০ শতাংশ চিনি ৯টি দেশ থেকে আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে ব্রাজিল থেকে কেনা চিনি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভেড়ার আগেই অদৃশ্যভাবে পণ্য কয়েকবার হাতবদল হয়। এতে প্রতি কেজি চিনির আমদানি মূল্য ৫৯-৬০ টাকা হলেও খালাসের আগে তা একশ টাকায় উঠে যায়। এলসি খোলার পরে পুরো প্রক্রিয়া আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হলেও প্রতিষ্ঠান থাকে আড়ালে।

একইভাবে তেল, ডাল ও অন্যান্য পণ্যের বেলায়ও ঘটে। যার কারণে এই কমিশন সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় বোধ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক সরকার না হওয়ায় সরকারও লাগাম টানতে পারছে না।

কেজিতে অন্তত ৪০-৫০ টাকা লুট
ব্রাজিলের এক টন চিনির দাম ৪৮০ প্রায় ডলার। চট্টগ্রামের পোর্ট পর্যন্ত আসতে প্রতি কেজিতে খরচ হয় ৫৯-৬০ টাকা। যদিও তা ভারতের বাজার মূল্যের চেয়ে কেজিতে ১৫ টাকার বেশি। অন্যান্য ব্যয়সহ সর্বোচ্চ আরও ২০ টাকা মিলে প্রতি কেজি ৮০ টাকায় পেতে পারেন গ্রাহক।

আমদানি মূল্য ৫৯-৬০ টাকা হলেও খালাসের আগে তা একশ টাকায় উঠে যায়। আমদানি করা সেই চিনি দেশে ১৪০-১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝ পথে অন্তত চারটি ধাপ অদৃশ্যভাবে সক্রিয়। যারা প্রতি কেজিতে অন্তত ৪০-৫০ টাকা লুটে নেয়। সারা দেশে পণ্য সরবরাহকারী ও এজেন্টরা নিচ্ছেন সবচেয়ে কম। প্রতি কেজিতে মাত্র ১০ টাকা নিয়ে ১৪০-১৪৫ টাকায় গ্রাহকের হাতে তারা তুলে দিচ্ছেন আমদানি করা পণ্য।  

রপ্তানিকারক দেশগুলো
দেশে যে চিনি উৎপাদন হয় তা চাহিদার মোট ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। বাকি ৬৫-৭০ শতাংশ চিনি ৯টি দেশ থেকে আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে গত বছরে ৪ লাখ কোটি টাকার চিনি আমদানি করা হয়েছে। দেশগুলো হলো- চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুর।

সরকার শুল্ক অব্যাহতি দিয়ে গ্রাহককে সুবিধা দেওয়া দিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই আমদানি পণ্যের বেশিরভাগ মুনাফা অদৃশ্যভাবে চুষে নেওয়া কমিশন সিন্ডিকেট দমনের দাবি জানিয়েছেন। এতে পণ্যের সরবরাহ বাড়বে, মূল্যস্ফীতির চাপ কমে বাজার স্থিতিশীল হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

আরবি/জেডআর

Link copied!