আমিন-স্বপন সিন্ডিকেটে সর্বনাশ হয়ে গেছে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার। ফলে সব ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও যেতে পারেনি ১৬ হাজার অভিবাসী কর্মী। প্রতিবছর হাজার হাজার শ্রমিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান ভাগ্য বদলের আশায়।
মূলত নির্মাণ, কৃষি ও উৎপাদন শিল্পে তাদের কাজ জুটে থাকে। তাদের গমন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। পরবর্তীতে হিসাব-নিকাশ মিলাতে না পেরে তাদের কাঁধে এসে পড়ে এক অসহনীয় আর্থিক বোঝা। তা ছাড়া মালয়েশিয়া পৌঁছে প্রার্থিত কাজ না পেয়ে তারা অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা এবং দুঃখজনক প্রতারণার শিকার হন। কখনো কখনো তারা কথানুযায়ী বেতনভাতাও পান না। এর মূল কারণ এই সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ায় এই সিন্ডিকেটের থাবা বিস্তৃত। সূচনা লগ্নে বাংলাদেশে সিন্ডিকেটের সদস্য ছিল ২৫ জন। দ্বিতীয় ধাপে ৭৫ জন। তৃতীয় ধাপে এর সংখ্যা উন্নীত হয় ১০৩ জনে। এই সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক হলেন বায়রার সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মেসার্স ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-৫৪৯) কর্ণধার রুহুল আমিন স্বপন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় স্বপনের অফিস। নেপথ্যে ছিলেন সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ। সিন্ডিকেটের মূল হোতা পতিত আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল।
অন্য সদস্যরা হলেন: লোটাস কামালের স্ত্রী কাশ্মিরী কামাল, কন্যা নাফিসা কামাল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ উদ্দিন, সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদ, নিজাম হাজারী, শওকত, ত্রিবেনী ইন্টারন্যাশনাল ও সেলিব্রেটি ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার বায়রার সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল, আবেদ আলী ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের কর্ণধার মোবারক উল্লাহ শিমুল গং। গোটা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হলেন মেসার্স ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার রুহুল আমিন স্বপন। সিন্ডিকেটের পক্ষে মালয়েশিয়ায় কাজ করেন আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিন। তিনি মালয়েশিয়া বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি। এই আমিনের মাধ্যমেই পুরো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত হয়। শুরুতেই তার মাধ্যমে বাংলাদেশে গঠিত হয় ২৫ সদস্যের সিন্ডিকেট।
যেভাবে দুর্নীতির ছক প্রথমেই গনণেচ্ছু কর্মীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা নেন এই সিন্ডিকেট সদস্যরা। অজুহাত দেখানো হয় এটি প্রসেসিং ফি’।
অথচ বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) প্রসেসিং ফি’ অথবা বহির্গমন ছাড়পত্র ফি’ হলো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। তাহলে সিন্ডিকেট সদস্যরা ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা করে কেন বাড়তি নিচ্ছেন! এ হিসাবে তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সরকার ও বায়রার চাপে যে ১৬ হাজার কর্মী যেতে পারল না, তাদের অনেককেই ১ লাখ ৩০ হাজার করে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখানেই বিশাল অংকের দুর্নীতির প্রমাণ মিলে। আর এই ১৬ হাজার বাদ দিয়ে ২০২২ সালের আগস্টে কর্মী গেছে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ। সরকার নির্ধারিত ফি’ ছিল ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু কর্মীদের কাছ থেকে ৫ লাখ ৪৪ হাজার করে নেওয়া হয়েছে- তা হলে তারা আনুমানিক আদায় করেছেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে আশ্চর্য্যরে বিষয়, কোটি কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা সহনীয় করতে সিন্ডিকেট সদস্যদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের জনশক্তি ব্যবসার সম্মুখভাগে নিয়ে আসা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের শেষে দিকে মালয়েশিয়া সরকার একটি সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগের জন্য বাংলাদেশের আড়াই হাজার রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্য থেকে ১০০ নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেয়। ফলে এখান থেকেই নেয় সিন্ডিকেট। পরে আরও তিনজন সিন্ডিকেটে যোগ দেন। ক’দিন আগে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা হয়। একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী মামলাটি করেন। মামলায় দুর্নীতি, মানবপাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগ করা হয়। এর আগে সিন্ডিকেটের অপকর্ম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিকে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর আড়ালে অর্থপাচার, মানবপাচার ও অভিবাসী ব্যয় বাড়ানোর অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে গত ২৪ অক্টোবর কথিত সিন্ডিকেটের দুই মূল হোতা রুহুল আমিন স্বপন ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিনকে গ্রেপ্তার করে হস্তান্তরের জন্য মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এক চিঠিতে বাংলাদেশের পুলিশ ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তার ও হস্তান্তরের অনুরোধ করেছে।
১৬ হাজার কর্মী যেতে না পারার কারণ কথিত এই সিন্ডিকেট যে কাজটি বিভিন্ন জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে- তারা এ কাজটি মালয়েশিয়া থেকে প্রথম পর্যায়ে কিনে আনেন জনপ্রতি চার হাজার রিঙ্গিত করে। যদি এক রিঙ্গিত বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৬ টাকা হয়, তাহলে মোট ব্যয় দাঁড়ায় জনপ্রতি ২ লাখ ৪ হাজার টাকা। শুধু কেনা বাবদই এ টাকা। এর ওপর আছে যাতায়াত, হোটেল ভাড়া ও বিবিধ খরচ। যদি ধরে নেওয়া যায় রিক্রুটিং এজেন্ট জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা লাভ করে, তাহলে এ হিসাবে মোট টাকা দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে সিন্ডিকেটের ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা যোগ হয়। ফলে খরচ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
তাহলে গমণেচ্ছু কর্মীদের কাছ থেকে ৫ লাখ ৪৪ হাজার, কখনো কখনো ৬ লাখ টাকা কেন নেওয়া হয় এর কারণ আজও অজানা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে একই কায়দায় কাজ কেনায় দাম বাড়িয়ে জনপ্রতি ৬-৮ হাজার রিঙ্গিত করা হয়। আর এভাবেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কর্মীদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
কাজের ধারা যেসব কোম্পানি বা কারখানা থেকে কাজ আনা হয়- তাতে ৫০ জনের চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে অ্যাটাস্টেসন আনা হয় ১০০-২০০ জনের। কর্মীদের মালয়েশিয়া নেওয়ার পর ৫০ জনকে কাজ দেওয়া হয়, বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয় রাস্তায়।
নির্মাণ খাতে নিয়োগ মালয়েশিয়া থেকে সরাসরি কাজ কেনা হয় এ-টু-এ নামে। এই এ-টু-এ কাজের কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কিছু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দালাল এ-টু-বি নামে কাজ সংগ্রহ করে দূতাবাস থেকে অ্যাটাস্টেশন করিয়ে আনে। এই এ-টু-বি নামেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো হয়। পরে এই কর্মীদের বাসা ভাড়া করে রেখে বিভিন্ন কোম্পানি ও কারখানায় সরবরাহ করা হয়। তাদের বেতন থেকে জনপ্রতি ১০-১৫, আবার কখনো ৫০ রিঙ্গিতও কেটে নেয় ওইসব দালালরা। এভাবে এই প্রক্রিয়ায় হতভাগ্য কর্মীরা যেমন সঠিকভাবে কাজ পায় না, কাজ পেলেও বেতন পায় না।
সুতরাং কর্মীদের জীবন কাটে খেয়ে না খেয়ে। অনেক গবেষণা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা-বার্তা বলে যতদূর জানা গেছে, ১৬ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যেতে না পারার অন্যতম কারণ হলো এসব কর্মী প্রধানত আসে গ্রামগঞ্জ থেকে। প্রায় প্রতি গ্রামেই আছে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল। এসব দালালরা কর্মীদের নিয়ে আসে ঢাকায়, এজেন্সি অফিসে। প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে এজেন্সি মেডিকেলের কথা বলে তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর দালালের পকেটে যায় কিছু টাকা।
মেডিকেলে উত্তীর্ণ হলে সিন্ডিকেটের ১০৩ লাইসেন্সের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণের জন্য কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হয়। টাকা না দিলে তারা প্রক্রিয়াকরণ বন্ধ রাখে। আর টাকা দেওয়া হলে প্রক্রিয়াকরণের পর ভিসা এবং প্রবাসীকল্যাণের ছাড়পত্র নেওয়া হয়ে গেলে কর্মীদের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী পুরো টাকাই নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সিন্ডিকেট সময়মতো সব ক্ষেত্রে টাকা পরিশোধ না করে নিজে এবং দালালদের মাঝে পুরো টাকাই ভাগাভাগি করে নেয়। এ জন্য তারা টিকিট এবং অন্যান্য খরচ নির্বাহ করতে পারে না। ফলে বিলম্বে ফ্লাইট দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আল্টিমেটাম দিলে কর্মীরা দালালদের তাড়া করে। সে সময় উপায়ান্তর না দেখে বিমান টিকিট কাটতে গেলে কমপক্ষে ১৫-২০ দিন, এমনকি এক মাসেও পাওয়া যায় না।
আর তখনই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ভুয়া টিকিট কেটে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দিয়ে কর্মীদের সান্ত্বনা দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে পৌঁঁছে তারা ভুয়া টিকিটের কথা জানতে পারে। কিন্তু করার কিছুই থাকে না। ততক্ষণে ফ্লাইট চলে যায় যথানিয়মে।
কথোপকথন অভিযোগ এবং সার্বিক অবস্থা জানার জন্য রুহুল আমিন স্বপনের টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অফিসে গিয়ে কথা বলার জন্য বলেন। এর পরপরই তিনি মালয়েশিয়ায় উড়াল দেন। সর্বশেষ জানা গেছে, বাংলাদেশ তাদের হস্তান্তরের অনুরোধ জানালে স্বপন ও আমিনুল ইসলাম- দু’জনেই কানাডা পালিয়ে গেছেন বলে জানা যায়।
আপনার মতামত লিখুন :