ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪
পুলিশে বদলি-বাণিজ্যের মহারাজা-২

ধনসম্পদে ভরপুর ধনঞ্জয়, স্বাক্ষরে পেতেন ১০ লাখ

মেহ্দী আজাদ মাসুম

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ১২:০৫ এএম

ধনসম্পদে ভরপুর ধনঞ্জয়, স্বাক্ষরে পেতেন ১০ লাখ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকা: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম ছিলেন ধনঞ্জয় কুমার দাস। সরকারি চাকরির বয়স তার ১৯ বছর। ছোট আমলা হলেও কাজ তার ছোট ছিল না। ২০০৫-এ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শেষ সময়ে সরকারি চাকরিতে (১৫০৮৯) প্রবেশ করেন। তবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে ২০১৮ সাল থেকে। এই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে উপসচিব হিসেবে যোগ দিয়েই তিনি পেয়ে যান অবৈধ আয়ের উৎস্য ‘টাকার খনি’। পুলিশে নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্যে কামিয়েছেন অন্তত ৫শ কোটি টাকা। শুধু স্বাক্ষর দিয়ে ব্যক্তিগত তহবিলেই নিতেন ১০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে ভারতে পলাতক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নামে নেওয়া এক থেকে তিন কোটির ভাগ থেকেও পেতেন একটি অংশ। এ ছাড়া পদায়িতদের কাছ থেকে নিতেন মাসোহারা। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠায় খনি থেকে টাকা তুলে ধনসম্পদে ভরপুর হতে তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। 

সরকারের অনুমোদনের পর দেশজুড়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়ন ও বদলির অর্ডার হতো স্বরাষ্ট্রের নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্যের এই মহারাজার স্বাক্ষরে। তিনি প্রথম দফায় ২০১৮ সাল থেকে ৪ বছর ৮ মাস আর দ্বিতীয় দফায় ২০২৩ সাল থেকে ১ বছর ৬ মাস ছিলেন স্বরাষ্ট্রের জননিরাপত্তা বিভাগে।

মধ্যে পদোন্নতির জন্য শুধু ৩ মাস ঘুরে এসেছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। সব মিলিয়ে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই ৬ বছরেই প্রায় শূন্য থেকেই হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যান ধনঞ্জয় কুমার দাস। গণঅভ্যুত্থান না হলে হয়তো আসাদুজ্জামান খান কামালের সংস্পর্শে থেকে এক দশক পূর্ণ করতেন অত্যন্ত চতুর এবং সাবেক দুর্নীতিবাজ সরকারের শীর্ষ এই কর্মকর্তা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ২০১৮ সালে এই মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় তার তেমন কোনো অর্থসম্পদ ছিল না। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁইও ছিল না। অনেক পাওনাদাররা সচিবালয়ের গেটে এসে টাকা নিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অথচ সোনার হাঁসের ডিম দেওয়ার মতো জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব পদটিতে যোগ দিয়ে এক মাসের মধ্যেই তিনি ঘুরে দাঁড়ান। পেয়ে যান টাকার খনি। ভারতে পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও গড়ে তোলেন অবৈধ অর্থ লেনদেনের সুসম্পর্ক। এরপর শুধু এগিয়েছেন আর বাড়িয়েছেন অর্থসম্পদ। এই স্বল্প সময়েই তিনি হয়েছেন অঢেল অর্থসম্পদের মালিক। মন্ত্রণালয় ও একটি তদন্ত সংস্থার সূত্র মতে, ধনঞ্জয় তার এই অবৈধ আয়ের সামান্য অংশ রেখেছেন দেশে। বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া ও ভারতে। দেশেও রয়েছে একাধিক বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়িসহ বিপুল সম্পদ। 

অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়া সাবেক ডিবিপ্রধান হারুনের সঙ্গে ধনঞ্জয় কুমার দাসের ছিল তার নীবিড় সখ্য। সখ্য ছিল বিসিএস প্রশ্নফাঁসের মূল হোতা কারাগারে আটক থাকা গাড়িচালক আবেদ আলীর সঙ্গেও। হারুন ও ধনঞ্জয়ের আস্কারা, সহযেগিতা ও প্রশ্নফাঁসের অর্থের ভাগাভাগিতে পিএসসির এই গাড়ির চালক হয়েছেন শতকোটি টাকার মালিক। ক্ষমতায় হয়েছিরেলন অপ্রতিরোধ্য।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, হারুন এবং ধনঞ্জয় চলচ্চিত্র-টেলিভিশনের নায়িকা এবং মডেলদের নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার যেতেন লং-ড্রাইভে। কখনো মুন্সীগঞ্জের ঢালিস আম্বারে, আবার কখনো কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের প্রেসিডেন্ট রিসোর্টে। রাতভর ফূর্তি করে সকালে ফিরতেন ঢাকায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পলাতক ডিবির হারুনের সহযোগিতা নিয়ে ধনঞ্জয় তার ছেলে সৌভিক দাস জয়কে পাঠান যুক্তরাষ্ট্রে। তার অবৈধ আয়ের একটি অংশ প্রথম কানাডায় এবং পরে তা যুক্তরাষ্ট্রে ছেলের কাছে রেখে আসেন। অবৈধ আয়ের টাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা এবং কানাডার টরেন্টোর বেগম পাড়ায় কিনেছেন আলিশান দুটি বাড়ি। এ ছাড়া কলকাতায় স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনদের অবৈধ আয়ের একটি অংশ কাছে রেখেছেন পুলিশে বদলি-বাণিজ্যের এই ‘মহারাজা’।

এক তারকা নারী সাংবাদিকের সঙ্গে ছিল ধনঞ্জয় কুমার দাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ধনঞ্জয়ের স্ত্রী শ্রাবণী সূত্রধর জলিকে এটিএন নিউজে সংবাদ পাঠিকা হিসেবে চাকরি দিয়েছিলেন ওই নারী সাংবাদিক। কারওয়ান বাজার এলাকায় তারা বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পূজা পালন করতেন। সেখানে উপস্থিত হতেন ধনঞ্জয় কুমার দাসসহ তার সিন্ডিকেটের অনেকেই। বর্তমানে তারা কেউ ওই টেলিভিশনে কর্মরত নেই। 

অভিযোগ রয়েছে, স্বামীর অবৈধ আয়ে অত্যন্ত বিলাসী জীবনযাপন করতেন শ্রাবণী সূত্রধর জলি। প্রায়ই ঘুরে বেড়াতেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বনানীর ১৩ নম্বর সড়কে ‘ত্রিভ’ নামে একটি ফ্যাশন হাউসের মালিক শ্রাবণী। সূত্রাপুর, নিকেতনসহ বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট করেছেন ধনঞ্জয়। তার ক্ষমতার প্রভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে চাকরি করছেন শ্যালিকা লাবণী সূত্রধর।

২০২২ সালের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ধনঞ্জয় কুমার দাসের সঙ্গে রয়েছে মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে জড়িত টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসের সম্পর্ক এবং নিয়মিত মাসোহারা গ্রহণের বিষয়টি।

আরবি/জেডআর

Link copied!