ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

ডিআইজি নুরুল এখনো অধরা

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৪, ১২:৫৪ পিএম

ডিআইজি নুরুল এখনো অধরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকার আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় হুকুমদাতা তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম। ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হয়েও এখনো বহাল আছেন তিনি। পুলিশ বাহিনীতে চাকরিও করে যাচ্ছেন। গত ১৫ বছরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক এই কেন্দ্রীয় নেতা। ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি গত দেড় দশকে গুম, খুন এবং নির্যাতনে জড়িত ছিলেন ডিআইজি নূরুল। তিনি নিজ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসপি লীগের প্রতিষ্ঠা করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। প্রভাব খাঁটিয়ে নিজের দুই ভাইকে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন। নুরুল এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অর্জন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। পুলিশ বাহিনীতে পুলিশ লীগের অন্যতম সদস্য সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নুরুল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ঘুষ, জমি দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার আমলে পুলিশ বাহিনীতে প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল ইসলাম ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি পদ ব্যবহার করে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে ঢাকা বিভাগের ১৩ টি জেলায় সবকটি থানার পুলিশকে সরাসরি গুলির নির্দেশদাতা ছিলেন। বর্তমানে তাকে রাজশাহীর শারদায় বদলি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী (সুপারনিউমারারি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের সরাসরি নির্দেশে আন্দোলনে গুলি চালানো ও লাশ পোড়ানো হয়েছে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করেছেন দলের অনুগত কিছু কর্মকর্তা। নূরুল তাদের মধ্যে একজন। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা (এসবি) এবং বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে তাদেরই ঘুরেফিরে পদায়ন করা হয়েছে। ওইসব পদে থেকে তারা সরকারের নানারকম গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন, নিয়ন্ত্রণ করেছেন পুরো পুলিশ বাহিনীকে। সরকারের শীর্ষ দায়িত্বশীলদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় অনৈতিক কর্মকাণ্ড মেনে নিতে না পারলেও প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না অন্যদের।

পুলিশ সূত্র মতে, উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলামরা ছিলেন সরকারের বিশেষ আস্থাভাজন। তিনিসহ অনুগত অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা নানাভাবে অনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন নুরুল ইসলাম। নুরুলের মতো ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পুলিশে এসেও ‘পুলিশ লীগ’ গঠন করেছিলেন। মূলত তারাই আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বাহিনী পরিচালনা করতেন। আলোচিত অনেক পুলিশ কর্মকর্তাদের বেশির ভাগকেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তবে নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া বর্তমান সরকার বা পুলিশ বাহিনী। নুরুল ডিএমপির রমনা, মতিঝিল ও ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার এবং নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার পুলিশ সুপার ছিলেন।  

ঢাকার আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ ২১ পুলিশ সদস্য,  আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৩৬ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার উপর গুলির নির্দেশদাতা ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামি হয়েও সরকারি পদে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। হত্যাযজ্ঞ এবং লাশ পোড়ানোয় সরাসরি অংশ নেওয়াদের অন্যতম কাফী সিটি করপোরেশনের কর্মী সেজে দেশত্যাগ করার সময় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন। এসপি কাফি পুলিশি রিমান্ডে ডিআইজি নুরুলের নির্দেশে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে বলে দাবি করলেও এখনো অধরা মাস্টারমাইন্ড নুরুল।

অভিযোগ আছে, ২০১৪ সালে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে চাকরি করার সময় থেকে সৈয়দ নুরুল ইসলাম জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে তাঁর সমর্থিত একটি পক্ষ তৈরি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। নিজের দুই ভাইকে জনপ্রতিনিধি বানান তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসপি লীগ নামে আলাদা একটি দল করে আলোচনায় আসেন। সে সময় তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমি দলপাগল টাইপের মানুষ। দলকে ভালোবাসি বিধায় দলীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে।’ চাঁপাইয়ের সন্ত্রাসীদের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ডিআইজি নুরুল এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকায় জেলার বাসিন্দারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে আতঙ্কের নাম ছিল কথিত ‘এসপি লীগ’। এই এসপি লীগের আনাগোনা ছিল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের। আর দূর থেকে এই এসপি লীগের সবধরনের কার্যক্রম চোখে চোখে রাখতেন ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম। ছিল নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীও।

নুরুলের ঝড়ো উত্থান

২০১৫ সালে নুরুল ইসলাম ঢাকা দক্ষিণ ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার ছিলেন। এ সময় তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ৬৮ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করেন। তারপর থেকেই আলোচনায় আসেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর থেকে তার চোখ পড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিতে। পুলিশে চাকরির সুবাদে সরাসরি তিনি রাজনীতির মাঠে না থাকলেও তার পরিবারের সদস্যদের সুযোগ করে দেন। এসব নিয়ে সাংবাদিকদের লেখাও ছিল বারণ। কারণ গণমাধ্যমকর্মীদের চাপে রাখতো নুরুলের সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নুরুল ইসলামের নির্দেশে তার সন্ত্রাসী বাহিনী ৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এসব মামলায় তার মতের বিরোধিতাকারীদের ‘ফাঁসানো’ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

ক্ষমতার জোরে দুভাইকে বানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি

নুরুল ইসলামের আপন দু’ভাই নজরুল ইসলাম ও মুনিরুল ইসলাম। নজরুল শিবগঞ্জ উপজেলার একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। একই সঙ্গে ইটভাটা ব্যবসায়ী। আরেক ভাই মুনিরুল পেশায় ছিলেন ঠিকাদার। ক্ষমতার জোরে নুরুল তার ভাই নজরুলকে উপজেলা পরিষদের চেয়্যারমান বানান। নজরুল নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। অথচ তিনি (নজরুল) ছিলেন শিবগঞ্জ পৌরসভা ৭নং ওয়ার্ডের বিএনপির সদস্য। তারপরও ত্যাগী আওয়ামী লীগের নেতাদের বাদ দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আপন ভাইকে নৌকা প্রতীক পাইয়ে দেন নুরুল। নৌকা প্রতীকের পাশাপাশি নিজের ক্ষমতার ব্যবহার করে নজরুলকে চেয়ারম্যান বানান নুরুল। পরবর্তীতে তার ভাইকে বানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। এদিকে তার আরেক ভাই মুনিরুলকে বানিয়েছেন শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। এই নির্বাচনেও ছিল পুলিশের প্রভাবÑ এমনই দাবি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের।

আরবি/জেআই

Link copied!