ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪
ভোলায় ছিল আধিপত্য

ডন শাওনের হদিস নেই

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৪, ১২:৫৫ এএম

ডন শাওনের হদিস নেই

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ভোলা-৩ আসনের একাধিকবার সংসদ সদস্য ছিলেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার আমলের প্রভাবশালী এই রাজনীতিক গত দেড় দশকে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক অপরাধ সাম্রাজ্য। আলোচিত ক্যাসিনো ব্যবসার অন্যতম হোতা ছিলেন শাওন। নিজ নির্বাচনী এলাকা ভোলা জেলায় রামরাজত্ব কায়েম করেন। নির্বাচনী হলফনামায় দেড় দশকে বাৎসরিক আয়কে ১০ লাখ টাকা থেকে ১৫ কোটিতে নিয়ে যান। চাঞ্চল্যকর যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যায় শাওনের নাম জড়িয়েছে। 

সাবেক এমপি শাওন ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সম্পদ লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

ভোলা, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়ে তুলেছেন। ২০১০ সালের উপনির্বাচনে ভোলা-৩ আসন থেকে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পরেই তিনি নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। মাদক চক্রের গডফাদার হিসেবেও তার কুখ্যাতি রয়েছে।

তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ছাড়াও দেশে-বিদেশে মাদক-স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনার তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের আয়ের বড় খাত ছিল মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট।

সরকারি প্রভাব খাটিয়ে দেশের বিমানবন্দর ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য ও সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণ চোরাচালান করতেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। ৫ আগস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন সাবেক এমপি শাওন।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দেশের ভেতর লুকিয়ে থাকলেও বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। এখনো তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুদক তার এবং তার স্ত্রীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ২০১০ সালে এমপি হওয়ার পর শাওনের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে। এমপি হওয়ার আগে বছরে তার আয় ছিল ১০ লাখ টাকা। এমপি হওয়ার পর ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তার আয় হয়েছে ১৫ কোটি টাকার বেশি। একসময় তিনি ঢাকার গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, মতিঝিল ক্লাব ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

২০১৯ সালে ক্যাসিনোকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সে সময় আত্মগোপনে চলে যান শাওন। বছর না ঘুরতেই আবারও তিনি প্রকাশ্যে চলে আসেন এবং ভোলার লালমোহন-তজুমদ্দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। ২০২০ সালে পাউবোর বাৎসরিক আপৎকালীন ফান্ডের পাঁচ কোটি টাকা তুলে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে আলোচনার জন্ম দেন। তার সিন্ডিকেটের সদস্য লালমোহনের মহিউদ্দিন, তজুমদ্দিনের আবু তাহের ও সুমন পাটোয়ারী, চাচড়ার রিয়াজ উদ্দিন ও সোনাপুরের ইকরাম পাটোয়ারী এখনো বহাল তবিয়তে ভোলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত দেড় দশকে শাওন ভোলাকে মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। প্রতি মাসে মাদক বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন শাওনের সিন্ডিকেট।

২০১৯ সালের অক্টোবরে সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরীর সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক। তখন ক্যাসিনোকাণ্ডে তার নামও আলোচনায় আসে। সে সময় অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নুরুন্নবী চৌধুরীর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য চায় দুদক। পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং এলজিইডির প্রকল্পসহ উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়নকাজ, বাৎসরিক বরাদ্দ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের মাধ্যমে শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পায় দুদক। সে সময় শাওনের বিরুদ্ধে হওয়া দুদকের মামলা ধীরগতিতে চলছে, এ অভিযোগ করে দুদকে চিঠি দিয়েছিলেন শফিকুল ইসলাম তুহিন নামের এক ব্যক্তি। চিঠিতে তিনি ভোলা-৩ আসনের জনগণের পক্ষে চিঠি দিয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন।

ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী প্রায় ২০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। ওই তালিকায় শাওনের নামও ছিল।

শাওনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের আগস্টে যুবলীগকর্মী ইব্রাহিম হত্যার অভিযোগ আছে। জাতীয় সংসদ এলাকায় শাওনের গাড়িতে থাকা তার লাইসেন্স করা অস্ত্রের গুলিতে নিহত হন যুবলীগকর্মী ইব্রাহিম। ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও ইব্রাহিমের পরিবার শাওনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা করেছিল। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত ২০২১ সালের ১৩ জুন এ আদেশ দেন। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পক্ষ থেকে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে ফের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২২ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

দুদক সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে শাওনের বিরুদ্ধে দাখিল করা অভিযোগটির অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রশিক্ষণ ও তথ্য-প্রযুক্তি) সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি টিম করা হয়। টিমের সদস্যরা হলেনÑসহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম, নেয়ামুল আহসান গাজী, আতাউর রহমান সরকার ও মনিরুল ইসলাম। কিন্তু দুদকের ডিজিকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়ায় ইকবাল হোসেন অনুসন্ধানে আগ্রহী হননি। ফলে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ বছর ৩০ এপ্রিল অবসরে যান সৈয়দ ইকবাল। ফলে অনুসন্ধান বন্ধ থাকে। গত ৫ আগস্ট  শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ২২ আগস্ট শাওনের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। 

দুদকের দাখিলকৃত অভিযোগে বলা হয়, সাবেক এমপি শাওন ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলার টিআরের দুই কোটি ২৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭৯৭, কাবিখা ও কাবিটার তিন কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৬ টাকা, ২৬০ দশমিক ৩৯ টন গম ও ২৩৪ দশমিক ৩৩ টন চাল বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

এমপি শাওনের সম্পদ : শাওনের আয়কর রিটার্নের কপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দাখিল করেন, সেটিতে তিনি ২৬ দশমিক ৫৪৫ শতাংশ জমির মালিক বলে উল্লেখ করেন, যার মূল্য দেখানো হয় এক কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। সঙ্গে ঢাকায় একটি বাড়ি ও একটি ফ্ল্যাট, লালমোহনে দুটি বাড়ি থাকার তথ্য দেন। যার মূল্য দেখান দুই কোটি ৭২ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৮ সালে নভেম্বর পর্যন্ত তার জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৪০ শতাংশে। এর মূল্য দেখানো হয় ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকায় দুটি বাড়ি ও লালমোহনে দুটি বাড়ি নির্মাণ করেন, যার মূল্য দেখানো হয় ১২ কোটি চার লাখ ২৮ হাজার টাকা। তার ব্যবসার মূলধন, গাড়ি, স্বর্ণালংকার ও ব্যাংকে জমাসহ মোট ১৭ কোটি ৪০ লাখ ৭০ হাজার ৬০০ টাকা। বছরে তার আয় ১৫ কোটি ৭২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৬ এবং ব্যয় পাঁচ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৭ টাকা। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে হলফনামা দাখিল করেন।

তাতে বলা হয়, তার ঢাকায় ও লালমোহনে ১৬ দশমিক ৬৮৫ শতাংশ জমি আছে, যার মূল্য চার কোটি ৪১ লাখ ৯৮ হাজার ২২০ টাকা। ঢাকায় দুটি ও লালমোহনে একটি আবাসিক বাড়িসহ জমির পরিমাণ ১৪৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যার মূল্য ১৪ কোটি ৮৮ লাখ ছয় হাজার ২৮৫ টাকা। তার ব্যবসার মূলধন, গাড়ি, স্বর্ণালঙ্কার ও ব্যাংকে জমা মোট ৩৩ কোটি ৫৫ হাজার ৭৩২ টাকা। তার ইসলামী ব্যাংকে ১০ কোটি টাকার লোন আছে। তার বছরে আয় এক কোটি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার এবং ব্যয় তিন কোটি ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪৫ টাকা।

আরবি/জেডআর

Link copied!