ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে দলটির কার্যালয়গুলোতে হামলা ও লুটপাট চালায় একশ্রেণির মানুষ। জেলায় জেলায় ঘটে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। এরপর থেকেই রাজনীতির মাঠ থেকে হারিয়ে যায় দেশের সবচেয়ে পুরোনো এই দল।
বিভিন্ন সংকটে দলটি ইতিমধ্যে জনবিছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের দোষেই জনবিছিন্ন হয়ে পড়েছে, যে কারণে দলের সভানেত্রীকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়াতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে। তার পরও রয়েছে নেতৃত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা। কেননা, এক যুগ পর শেখ হাসিনা দলের হাল ধরতে শারীরিকভাবে সক্ষম থাকা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে নেতা-কর্মীদের মধ্যেও।
জানা গেছে, সরকারের পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা উধাও হয়ে গেছেন। আত্মগোপনে থেকে সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা জানিয়েছেন, বেঁচে থাকলে রাজনীতি করা যাবে। দলের এই সংকটে নিজেদের বেঁচে থাকাটাই জরুরি।
এদিকে সুশিল সমাজের অনেকেই বলছেন, কয়েক মাস আগে যাদের একচেটিয়া দাপটে কেউ কথা বলতে পারেনি, তারা এখন রাজনীতিতে নেই। একেবারেই অদৃশ্য হয়ে দূর থেকে রাজনৈতিক সমালোচনা করছেন।
এদিকে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগ, সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া অসংখ্য এমপি-মন্ত্রী বিভিন্ন অপরাধের কারণে জেলে, আবার কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হচ্ছেন। সব মিলিয়ে দলটি যেন তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
কেন এমন অবস্থা আ.লীগের: টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের এক আন্দোলনে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। দলের এমন হাল নিয়ে হতাশ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলেছেন, হঠাৎ আওয়ামী লীগ ওপর থেকে নিচে ছিটকে পড়বে, সেটা কখনো ভাবা যায়নি। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী সংগঠনকে ধ্বংস করেছে। তাদের অবৈধ অর্থ উপার্জন, নিবেদিতপ্রাণদের দলে জায়গা না দেওয়া ও বৈষম্যের কারণে আজ দলের এই দশা। সাড়ে ১৫ বছরের দাপুটে শাসনের অবসানের পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় টানা কয়েক দিন কথা বলেছেন। কিন্তু একেক দিন তার একেক ধরনের বক্তব্যে কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। জয়ের কারণে দলটির নেতাকর্মীদের মনোবলও একেবারেই ভেঙে পড়ে। অনেকেই সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কিছু নির্দেশনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারের পর দলটির নেতাকর্মীরা ফের রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, দলের পতনের পর প্রায় চার মাসেও সংগঠনের কাযর্ক্রম পরিচালনায় দলটির আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছেন না। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
নেতাকর্মীরা পলাতক, একসঙ্গে বসার মতো কার্যালয়ও নেই বললেই চলে।
জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদেরা বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের কারণে আওয়ামী লীগের পতন দলটিকে একেবারেই পঙ্গু করে দিয়েছে। তাদের দাবি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম আর রাজপথের তৎপরতা এভাবে পুরোপুরি থমকে যায়নি, যেমনটা এবার দেখা যাচ্ছে। দলীয় একটি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী দেশেই আছেন, কিন্তু নিজের ও পরিবারের চিন্তা করে অনেকেই গণমাধ্যমের সামনে আসতে চাইছেন না।
তবে দলটির সর্মথক ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের দাবি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেও দেশে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম বহু বছর সাধারণ মানুষ মুখেও আনতে পারেনি। জাতীয় চার নেতাসহ বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। কিন্তু এসব সংকট মোকাবিলা করেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল দলটি। ঠিক তেমনিভাবেই আওয়ামী লীগ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলেও আশাবাদী দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পলাতক নেতা) গত বৃহস্পতিবার হোয়াটসঅ্যাপে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘আপাতত আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে চিন্তার দরকার নেই। সময় হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ এটা বলেই তিনি ফোন কেটে দেন।
এ বিষয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেছে। এর থেকে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের শিক্ষা নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে যাতে এমনটি না হয়। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি দেশের জনগণেরও সচেতনতা জরুরি।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে গুম, খুন, গণহত্যা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ করেছে। আমরা সেটা দেখেছি। জনগণ সচেতন হলে হয়তো আওয়ামী লীগ এসব করতে পারত না। এখন দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ সরকার ও বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া শীর্ষ নেতা, পলাতক থেকে শুরু করে সবার বিচার চায়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ধরে রাখতে সবাইকে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে এবং জনগণের বার্তা বুঝে ক্ষমতায় থাকতে হবে। জোর করে কেউ ক্ষমতায় থাকতে চাইলে বা দেশের মাটিতে কোনো ধরনের অপরাধ করলে এ দেশের মানুষ সেটা মেনে নেবে না। অন্যথায় দলীয় সুবিধাভোগীদের অবস্থা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মতো হবে, যা দেশের জন্য এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ভয়ংকর বার্তা দেয়।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ ও ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে শঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে যে ভুল করেছে, সেটা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, দেশের মানুষ তাদের আর মেনে নেবে কি না, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে রাজনীতিতে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সংশয় রয়েই যায়।
আপনার মতামত লিখুন :