ঢাকাই সিনেমার নায়িকা মাহিয়া মাহীকে ধর্ষণের হুমকির ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রিত্ব হারান ডা. মুরাদ হাসান। তিনি ছাত্রদলের নেতা হিসেবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। জামালপুর-৪ আসনে দুবারের সংসদ সদস্য ছাড়াও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। গত দেড় দশকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঢাকা ও জামালপুরে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। বছরে বছরে সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়েছেন বহুগুণ। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে সুন্দরী নায়িকাদের সঙ্গ পেতে মরিয়া থাকতেন। বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনায় থাকা মুরাদ রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসায় আত্মগোপনে আছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর ডা. মুরাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে একাধিক মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন আদালত। গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। ধানমন্ডির একটি অভিজাত ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন। ফ্ল্যাটটি মুরাদের টাকায় কেনা হলেও অন্য একজনের নামে রেজিস্ট্রশন করা। কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে সেখানে বসবাস করছেন। নিজের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর বন্ধ করে রেখেছেন। তবে রোমিং সুবিধার একটি বিদেশি নম্বর ব্যবহার করছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে মাঝে মাঝে গভীর রাতে কালো গ্লাসের দামি গাড়িতে করে অবস্থান পরিবর্তন করেন।
উল্লেখ্য, ধানমন্ডি এলাকায় নামে-বেনামে ডা. মুরাদের একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে, যার অধিকাংশ অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে কেনা। আত্মগোপনে থাকতে মুরাদকে সহায়তা করছেন প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা আওয়ামী লীগ আমলে নানাভাবে সুবিধাভোগী ছিলেন।
২০২১ সালের অক্টোবরে শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে দেওয়া এক বক্তব্যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রথম বিতর্ক সৃষ্টি করেন তিনি। তখন সমাজের বড় একটা অংশ তার সমালোচনা করে। তবে ’৭২-এর সংবিধানের পক্ষে বলায় একটা অংশের সমর্থনও পান ডা. মুরাদ হাসান। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের পক্ষে, ’৭২-এর সংবিধানের পক্ষে তার অবস্থানও শেষ পর্যন্ত বিতর্কই তৈরি করে তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর শব্দচয়নের কারণে। যেভাবে তিনি ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, এটা আমি মানি না’ বলছিলেন; তাতে অনেকেই এটাকে ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান বলে ধরে নিয়ে সমালোচনা করেন। বিভিন্ন সময়ে বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। সে সময় বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, তারেক রহমান ও তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে যে ভাষায় তিনি সমালোচনা করেছেন, তা ছাড়িয়ে যায় শালীনতার সব সীমা।
একই সময়ে তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল ছাত্রলীগের নেত্রীদের নিয়ে অশ্লীল অভিযোগ করে ধীক্কৃত হন নিজ দলেও। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ে তিনি বলেছিলেন, এরা নিজেদের হলে থাকে না, ঘুমায় হোটেলে হোটেলে। কারণ, ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার মজা আর রোকেয়া হল ও শামসুন নাহার হলে থাকাটা কি এক কথা? এসব বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে তার পৃথিবী, বাড়তে থাকে সমালোচনার পরিধি। নিজের এসব অশালীন বক্তব্যকে জায়েজ করার জন্য বারবার তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মা হিসেবে সম্বোধন করতেন এবং বলতেন, তিনি যা করছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই করছেন। কিন্তু সেটা যে সত্য নয়, তা প্রমাণিত হতে সময় বেশি লাগেনি। তার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয় তার দুই বছরের পুরোনো একটি টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস হওয়ায়। তার অশ্রাব্য বক্তব্যের কারণে তিনি নেট দুনিয়ায় তুমুল সমালোচনার শিকার হন এবং পরে মুরাদ টাকলা নামে পরিচিত ও হাসাহাসির কারণ হন।
নায়িকা মাহিকে ধর্ষণের হুমকি: ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুরাদ হাসানের সঙ্গে চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন ও নায়িকা মাহিয়া মাহির একটি ফোনালাপ ভাইরাল হয়। যেখানে তিনি মাহিয়া মাহির সঙ্গে অশ্লীলভাবে কথা বলেন এবং তার কাছে যেতে বলেন। ওই কথোপকথনে তিনি মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। পুরো বক্তব্যে ‘অশ্রাব্য’ কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়। বিষয়টি দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর ই-মেইলের মাধ্যমে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তবে পদত্যাগের জন্য তিনি ‘ব্যক্তিগত কারণের’ কথা উল্লেখ করেন। তাকে প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর জেলার আওয়ামী লীগের কমিটির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মুরাদের যত সম্পদ: পাঁচ বছরের ব্যবধানে জামালপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. মুরাদ হাসানের আয় বেড়েছে পৌনে ৮ গুণ। আর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে পৌনে ২ গুণ। তবে নগদ টাকা ও ঋণ নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিগত ২০১৮ সালে ডা. মুরাদ হাসান এমপির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ২ কোটি ৪ লাখ ৫১ হাজার ৯১৬ টাকার। এর মধ্যে অস্থাবর সম্পত্তি ১ কোটি ৫৪ লাখ ৩ হাজার ৯৬৬ টাকা এবং স্থাবর সম্পত্তি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার ৯৫০ টাকার। সেই সময় তার ঋণ ছিল ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে নগদ কোনো টাকা ছিল না তার। সেই সম্পত্তি পাঁচ বছরে বেড়ে ৩ কোটি ৭৪ লাখ ১৮ হাজার ৭১৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এতে তার সম্পত্তি বেড়েছে পৌনে ২ গুণ। সে সময় তার বার্ষিক আয় ছিল ১৩ লাখ ৮৩ হাজার ২৮৩ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই আয় বেড়ে ১ কোটি ৭ লাখ ৮ হাজার ৬৪৪ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার ঋণ ও নগদ টাকা না থাকলেও আয় বেড়েছে পৌনে ৮ গুণ।
থানায় স্ত্রীর অভিযোগ: মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে তার স্ত্রী চিকিৎসক জাহানারা এহসান ৬ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে নির্যাতন ও হত্যার হুমকি প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগে সাধারণ ডায়েরি করেন। এর আগে তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান। ফোন পেয়ে পুলিশ তাদের ধানমন্ডির বাসায় যায়। এরপর ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার স্ত্রী ডা. জাহানারা এহসান। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রাজিব হাসান। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ জিডি তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই তদন্ত কোন পর্যায়ে তা জানাতে পারেনি থানার পুলিশ।
ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক ছিলেন মুরাদ: দীর্ঘ এক বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ছাত্রদলের নেতৃত্ব দেন মুরাদ হাসান। একসময় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি ছাত্রদলের খোলস পাল্টে ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ক্ষমতার পালাবদলে তিনি সংগঠন পাল্টে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ নেতা বনে যান।
তৎকালীন ছাত্রনেতারা বলছেন, দীর্ঘ এক বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ছাত্রদলের নেতৃত্ব দেন মুরাদ। ১৯৯৩ সালে এম-৩০ ব্যাচে মুরাদ হাসান এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রদলের কমিটির নেতারা সবাই ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যান। তবে মুরাদ ক্যাম্পাসে থেকে যান। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর ধাপে ধাপে ওপরে উঠে আসেন মুরাদ। তারপর ১৯ মে ২০১৯ থেকে ৭ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী হন ডা. মুরাদ হাসান।
আপনার মতামত লিখুন :