# মোহাম্মদ আলীর সীমাহীন দুর্নীতি
# ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন
# যৌন হয়রানির অভিযোগও মিলেছে
ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নাজেহাল করতে পুলিশের অপরাধ বিভাগকে (সিআইডি) ব্যবহার করেন বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া সিআইডির সাবেক প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মাদ আলী মিয়া। শেখ হাসিনাকে খুশি করতে সিআইডির প্রভাব খাটিয়ে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি।
দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার নারী পুলিশ সদস্যদের যৌন হয়রানির অভিযোগও রয়েছে। বারবার অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছেন তিনি।
দুদকের একাধিকবার অভিযোগ জমা পড়লেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে ঘুষ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, অনিয়ম-দুর্নীতি, সিআইডি সদর দপ্তরে নিজ বলয় তৈরি, আইনবহির্ভূত কার্যক্রম, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নিজের পৈতৃক সম্পদে পর পরিণত করেছিলেন সংস্থাটির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া। পুলিশের এই অতিরিক্ত আইজিপি সম্প্রতি বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন সিআইডির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। এতদিন প্রভাব খাটিয়ে যাদের ক্ষমতা খর্ব করে রেখেছিলেন তিনি। ড. মোহাম্মাদ ইউনূসকে মামলার জালে জড়িয়ে নাজেহাল করার কারিগর তিনি।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন মোহাম্মাদ আলী মিয়াকে গত ২২ আগস্ট বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। পুলিশ প্রশাসনে চলমান ব্যাপক সংস্কারের মধ্যে দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় পুলিশের শীর্ষস্থানগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রভাব খাটিয়ে। সিআইডিতে প্রচলিত রয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠতার নাম করে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটিকে ‘মগের মুল্লুক’ বানিয়ে রাখতেন।
অভিযোগ রয়েছে, মামলা রুজু, অভিযান, তদন্তের সিদ্ধান্ত থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত আইনবহির্ভূতভাবে নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক সিআইডি প্রধান। তার অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দ করারও সুযোগ ছিল না। তার এই সিন্ডিকেটের ‘মিডিল ম্যান’ ছিলেন বর্তমানে সিআইডি সদর দপ্তরে কর্মরত বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো-পূর্ব) এ, কে, এম এমরান ভুঞা।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী মিয়া বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি পুলিশে যোগ দেন। আর ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট সিআইডি প্রধান হন। দুই বছর সিআইডি প্রধান থাকাকালে তিনি কোনো নিয়মনীতিকেই পরোয়া করেননি। পিছপা হননি বিগত সরকারের ‘প্রেসক্রিপ্টেড’ আজ্ঞা পালনে। বিশেষ করে ওই সরকারের ‘অপছন্দ’ ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে নানা কূটকৌশলে সিআইডিকে ব্যবহার করতেন তিনি।
এছাড়া সিআইডির বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তার অসৌজন্যমূলক আচরণে নানা সময় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করত অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে। শুধু সিআইডিতেই নয়, এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি, মানিকগঞ্জ ও হবিগঞ্জের জেলা পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন পদে থাকাকালেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কম ছিল না।
মানিকগঞ্জ ও হবিগঞ্জের এসপি থাকার সময় কনস্টেবল নিয়োগ বাণিজ্য করার অভিযোগ ছিল। পুলিশের উচ্চমহল তার এসব অপকর্মের খবর জানত। তবে তৎকালীন সরকারের ‘ঘনিষ্ঠ’ কর্মকর্তা হিসেবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশে তিনি মোহাম্মদ আলী মিয়ার মতো সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা কর্মকর্তা আর দেখেননি। এছাড়া তার মতো অর্থলিপ্সু কর্মকর্তা বাহিনীর জন্যই কলঙ্ক ছিল।
মোহাম্মদ আলী মিয়া সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিতেন। আর অবৈধ উপার্জনের অর্থ দিয়ে নিজের ক্ষমতা বলয় সবসময় টিকিয়ে রাখতেন। অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ আলী মিয়া নিজের সেই সিন্ডিকেটে কতিপয় অধস্তন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও যুক্ত করেন। তাদের দিয়ে কয়েকশ ভুয়া অভিযোগ এনে তদন্ত করার নামে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, মোহাম্মদ আলী মিয়া সিআইডিতে যেসব অন্যায়, অপরাধ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম সরকারি বরাদ্দ মেরে দেওয়া। তার এ কাজে সহযোগী ছিলেন সিআইডির দুজন বিশেষ পুলিশ সুপার আর একজন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার।
সূত্রটি বলছে, মোহাম্মদ আলী মিয়ার সিন্ডিকেট কাগজে-কলমে সিআইডির বহু কর্মকর্তাকে এককভাবে গাড়ি ব্যবহার দেখাতেন। কিন্তু বাস্তবে বিশেষ পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপারদের এককভাবে কোনো গাড়িই দেওয়া হতো না। বরং কয়েকজন কর্মকর্তাকে মিলিয়ে একটি শেয়ারিং গাড়ি দেওয়া হতো। এভাবে এসব গাড়ির জন্য প্রতি মাসে সরকারি বরাদ্দ অর্ধ কোটি টাকা লোপাট করা হতো।
ধরাকে সরাকে জ্ঞান করা সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলেও পুলিশে প্রচলিত আছে। দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, বিরোধী মতের লোকজনকে জিম্মি করে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার ছিল তার অবৈধ অর্থের উৎস।
অনুসন্ধানে মোহাম্মদ আলী মিয়ার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশকিছু জমির তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশি এক ব্যক্তির মালিকানাধীন রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার তিনি। লন্ডনে থাকা ছেলে আফনান লাবিব এই ব্যবসা দেখভাল করেন। ঢাকায় মোহাম্মদ আলীর বাড্ডা মৌজায় আফতাবনগরের কাছে আনন্দনগরে ১২ দশমিক ৩৭ শতক জমির প্লট, মিরপুর বাউনিয়া মৌজায় ৮ দশমিক ২২ শতক জমি, পূর্বাচলে ৫ কাঠা ও কেরানীগঞ্জে ৫ কাঠার প্লট রয়েছে। এছাড়া তিনি অন্যের নামে একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক এই সিআইডি প্রধান। সে সময় সিআইডির কয়েকজন কর্মকর্তা এ কাজে তাকে বিরত রাখতে চাইলে তিনি তাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে বলে দাবি করেন। পরে সিআইডির মানিলন্ডারিং শাখায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর চিঠি ইস্যু করেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৭ আগস্ট মোহাম্মদ আলী সিআইডি কার্যালয়ে এসে এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র সরিয়ে নেন।
আপনার মতামত লিখুন :