দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখভাল করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এর প্রধান মহাপরিচালক, পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন), পরিচালক (অর্থ ও ক্রয়)সহ শীর্ষ অনেক পদই শূন্য। শুধু মাউশি নয়; দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ৬টি শিক্ষা বোর্ডে নেই চেয়ারম্যান। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিপ্তর, এনসিটিবিসহ শিক্ষার বিভিন্ন দপ্তর-অধিপ্তরের অধিকাংশ শীর্ষ পদই শূন্য। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও ও স্কুলের শীর্ষপদসহ রয়েছে শিক্ষক সংকট। শিক্ষার এসব শীর্ষপদ দীর্ঘদিন থেকে শূন্য থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।
স্থবিরতা কাটাতে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই বলে জানা গেছে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তার দাবি, অনেক শীর্ষ পদে শূন্য হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পদ শূন্য রয়েছে। পদগুলো পূরণের লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা করছি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর চাপের মুখে পদত্যাগ করেন পতিত সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত শীর্ষ অনেক কর্মকর্তা। কাউকে কাউকে আবার আপত্তির মুখে সরিয়েও দেয় সরকার। এর বাইরে গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের পাশে না থাকায় এবং শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করার অজুহাতে বিতর্কিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপউপাচার্য, রেজিস্টার, ট্রেজারারসহ প্রশাসনিক পদধারীরে বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিসহ পদধারী শিক্ষকরা নিজ নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষকসহ বিতর্কিত শিক্ষকরা আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কাউ কাউকে আবার অব্যাহতিও দেয় সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথমে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ইউজিসির চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ। পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীরসহ ইউজিসির পূর্ণকালীন সদস্যরা পদত্যাগ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজকে ইউজিসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর কয়েক দফায় অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান ও অধ্যাপক ড. মাছুমা হাবিবকে স্থায়ী সদস্য নিয়োগ নিয়োগ দেয় সরকার। তারপরও শূন্য রয়ে গেছে একটি স্থায়ী সদস্য পদ। গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি পদও শূন্য।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মাউশি থেকে পদত্যাগ করেন বিদায়ী সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমদ। পরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক এবিএম রেজাউল করীমকে মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর গত ১৮ ডিসেম্বর মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব পাওয়া শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তা গত ৩ জানুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন। অধ্যাপক এবিএম রেজাউল করীম মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেলেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) পদে কাউকে নিয়োগ দেয়নি সরকার। এ ছাড়াও পরিচালক (অর্থ) অধ্যাপক মোজাক্কার হোসেন চৌধুরী এবং মাধ্যমিক উইংয়ের উপপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিনও সম্প্রতি পিআরএলে গেছেন। ফলে দেশের শিক্ষাঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা অভিভাবকশূন্য।
অন্যদিকে দেশের সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডসহ ১১টি শিক্ষা বোর্ড এসএসসি-এইচএসসিস ও সমমান পরীক্ষা নেওয়া, স্কুল-কলেজের পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি দেওয়া, ভর্তি প্রক্রিয়াসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। অথচ এসব বোর্ডের মধ্যে ৬টি বোর্ডেই চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদ শূন্য। সূত্রমতে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষ করে ৩১ ডিসেম্বর অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়াও গত পহেলা জানুয়ারি যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মর্জিনা আক্তার, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. নিজামুল করিম, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আবু তাহের, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. অলিউর রহমান। বাকি চেয়ারম্যানদের মধ্যে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া আরও দুই-একজন চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বোর্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের। চেয়ারম্যানসহ বোর্ডটির রেজিস্ট্রার, প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক, উপ-রেজিস্ট্রার (প্রশাসন), উপ-রেজিস্ট্রার (কমন), উপ-মাদ্রাসা পরিদর্শক-২, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (গোপনীয়) ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞসহ গুরুত্বপূর্ণ ১১টি পদের মধ্যে সাতটি শূন্য রয়েছে। এ ছাড়াও বোর্ডের ১৯২টি পদের ৬৮টিতে নেই লোকবল। অফিস সময়ের বাইরে কাজ করেও সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা। এসব পদ শূন্য থাকায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বোর্ডের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় কাজে বোর্ডে এসে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রমে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
মাদ্রাসা বোর্ডসহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের এত পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম, সময়াবদ্ধ ক্রয় প্রক্রিয়া, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি, গভর্নিং বডি, নির্বাহী কমিটি, এডহক কমিটি অনুমোদনের আবেদন নিষ্পত্তি কার্যক্রম, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তি কার্যক্রম, অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন আবেদন নিষ্পত্তিসংক্রান্ত কার্যক্রম, শিক্ষক-কর্মচারীদের চূড়ান্ত বরখাস্তের আবেদন নিষ্পত্তি ও বিভিন্ন মামলার বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। বিভিন্ন সেবা নিতে বোর্ডে আসা কর্মকর্তাদেরও সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সরকার পতনের পর শিক্ষায় অনেক পদ শূন্য হয়েছিল। আমরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের গতি ফিরিয়েছি। ইউজিসিসহ অনেক শূন্যপদ পূরণ করা হয়েছে।
বাকিগুলোও শিগগিরই পূরণ করা হবে। আশা করছি, শিক্ষায় এই সংকট বেশিদিন থাকবে না। ওদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা আগামী বছরের ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হবে। এর আগে কেন্দ্র অনুমোদন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ নানা প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব পদ পূরণ না করলে পরীক্ষা নিয়ে পড়তে হবে কঠিন পরিস্থিতির মুখে।
অপরদিকে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন এবং পাঠ্যবই ছাপার বিষয়টি দেখবাল করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বোর্ডটির গুরুত্বপূর্ণ পদ সদস্য (অর্থ)সহ গুরুত্ব পূর্ণ অনেক পদ শূন্য। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসানের শেষ কর্মদিবস ২৬ জানুয়ারি। ফলে এনসিটিবিও হয়ে পড়ছে অভিভাবকশূন্য। এ ছাড়াও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন), ময়মনসিংহ বিভাগ, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের পরিদর্শক, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (ভোকেশনাল), সহকারী পরিচালক-০৮, সহকারী পরিচালক-১১ (এমপিও)সহ গুরুত্বপূর্ণ আরও বেশ কয়েকটি পদ শূন্য।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর পদ ছেড়ে পালিয়েছেন। এরপর দীর্ঘদিন থেকেই শূন্য পদ দুটি পূরণের কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। দুটি প্রতিষ্ঠানের সচিব পদ শূন্য থাকায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবসরের নেওয়ার কল্যাণ ও অবসরের টাকা প্রদান কাজ থমকে আছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে কয়েক হাজার শিক্ষক। এর বাইরেও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের মহাপরিচালকসহ অধিকাংশ পদ শূন্য থাকাসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরেও (ডিআইএ) কয়েকটি পদ শূন্য থাকায় থমকে আছে নানা কার্যক্রম।
সূত্রগুলো বলছে, মাঠ পর্যায়েও একই অবস্থা। দেশের অনেক জেলা-উপজেলায় শিক্ষার বিভিন্ন অফিসেও নেই পর্যাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী।
বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোর করুন অবস্থা। বিগত সরকারের পতনের পর সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রধানসহ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে আন্দোলনে নামেন একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। এদের মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও অন্য কোনো শিক্ষক আওয়ামী লীগের পদধারী কিংবা সমর্থক ছিলেন, তাদের অনেককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কোনো কোনো শিক্ষককে আবার প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষই সাময়িক ও স্থায়ী অব্যাহতি দেয়। দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এমন কিছু শিক্ষককেও পদত্যাগ করানো হয়। এর বাইরেও অনেক শিক্ষক আছেন, যারা পদত্যাগ না করলেও আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়ার আশঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত রয়েছেন।
এই পদত্যাগ কিংবা অব্যাহতিতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা খুব একটা সমস্যায় পড়েননি। তাদের ওই প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য কোনো স্থানের প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু বিপাকে পড়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। কারণ অব্যাহতি কিংবা বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করানোর পর তাদের বেতন বন্ধ রেখেছে সরকার ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এমনটাই জানা গেছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঠিক কতজন শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে। তবে রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোর করে পদত্যাগ, অপসারণ, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক ছুটি নিতে বাধ্য হওয়া শিক্ষকরা মিলে করেছেন ‘পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষক জোট’।
জোটটি জানিয়েছে, ‘আন্দোলনের পর ন্যূনতম দুই হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। যার মধ্যে ৯৫ শতাংশই প্রতিষ্ঠানের প্রধান।’ এসব শিক্ষকের বিষয়টি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের এমন অভিযোগ মিলেছে।
আপনার মতামত লিখুন :