সম্প্রতি ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা। এরই মধ্যে ইসকন নেতা চিন্ময় দাসের ইস্যুতে বাংলাদেশ নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ ছাড়া সে দেশের গণমাধ্যমও সেই আগুনে ঢেলেছে ঘি। বিদ্যমান সংকট নিরসনে এরই মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গত বুধবার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। দেশের স্বার্থে একমত হয়েছেন সবাই। সব ধর্মের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার করেছেন বৈঠক। দেশের কারও মধ্যে সমস্যা না থাকলেও ভারতের উসকানি যেন থামছেই না। এমন পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের আলোচনা জোরালো হচ্ছে।
এই উদ্দেশ্যে এরই মধ্যে কয়েকটি দল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, নির্বাচনের আগেই জাতীয় সরকার গঠন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই মুহূর্তে জাতীয় সরকার গঠনে আগ্রহী নয়। দলটি চাইছে নির্বাচনের পরে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে। তাদের চাওয়া দ্রুত নির্বাচন। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনো স্পষ্ট করা হয়নি।
জাতীয় সরকারের ধারণা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি প্রস্তাব দেন, দীর্ঘদিন যারা হাসিনাবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন, তাদের নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠন হবে। অর্থাৎ, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা জাতীয় সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করবে। বিএনপি বলছে, নির্বাচনে যারা জয়ী হবেন, তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। তবে কেউ জাতীয় সরকারে যেতে না চাইলে তারা বিরোধী দলে থাকবেন। গত সেপ্টেম্বরের এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর একটি জাতীয় সরকারের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসায় দেশ প্রথম দিন থেকেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে একটি বিরাট অংশ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশ গঠনে কোনো অবদান রাখতে পারেনি। স্বাধীনতার পরপর জাতীয় ঐক্যের শক্তিকে ব্যবহার না করে সেদিন যে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, আগামী দিনে আমরা তার পুনরাবৃত্তি চাই না।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানে দেশছাড়া হওয়ার পর ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। চার মাসের মাথায় এসে সরকার দেশি-বিদেশি নানা সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকটা বেকায়দায় সরকার। প্রথম থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। সব মত ও আদর্শকে ভারত বিরাজমান সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজনৈতিক দলের সংলাপে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর জাতীয় সরকারের প্রস্তাব তুলে ধরেন।
তিনি মনে করেন, সামনে আরও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। এগুলো মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তাব ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীজনদের নিয়ে আগামী দুই বছরের জন্য জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত। গণঅধিকার পরিষদ মনে করে, কবে নির্বাচন দেবে কিংবা কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, অন্তর্বর্তী সরকার তাও স্পষ্ট করছে না। তাই দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ এবং রাজনীতিতে গুরুত্ব আছে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। তাদের সমন্বয়ে দেশ পরিচালিত হবে। জাতীয় সরকার হলে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সরকারের প্রধান হবেন। বাকি উপদেষ্টারাও এই জাতীয় সরকারে থাকতে পারেন। জাতীয় সরকারে যুক্ত হবেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম রূপালী বাংলাদেশেকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় সরকারের কথা বলে আসছি। ঐক্য মজবুত করতেই জাতীয় সরকার প্রয়োজন। জাতীয় সরকার থাকলে দেশদ্রোহীদের মিশন সফল হবে না। সব নিবন্ধিত এবং প্রতিনিধিত্বশীল আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে জাতীয় সরকার। এখন যেহেতু একটি সংকট চলছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় সরকার করলে মন্দ হবে না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও বিশিষ্টজনের মতামতও নেওয়া যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে নির্বাচন একটু দেরি হলেও আপত্তি নেই।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘জাতীয় সরকার নিয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এখনো এ বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি। আমরা মনে করি, ভারতীয় অপপ্রচার রোধে আমাদের জাতীয় ঐক্য দরকার। এই ঐক্য গড়ে তুলতে সকল পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল করার কথা গুরুত্ব দিয়ে বলেছি। আমার মনে হয় না এতে কেউ আপত্তি করবে। জাতীয় সরকার হলে সবার জন্যই মঙ্গল হবে বলে আমি মনে করি।’ যদিও বিএনপি মনে করছে জাতীয় সরকারের চেয়ে এখন জাতীয় নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিগত ১৫-২০ বছর বা দুই দশক ধরে আমাদের নতুন প্রজন্মের কেউ ভোট দিতে পারেননি। তাদের ভোটাধিকার দ্রুত ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই জাতীয় নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের পর বিএনপি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের পক্ষে। আমরা বিষয়টি আগেই পরিষ্কার করেছি। তবে কেউ কেউ জাতীয় সরকার করতে চাইছে এখনই। তাদের উদ্দেশ্য আমরা জানি। জাতীয় সরকার হলে নির্বাচন বিলম্বিত হবে। আর জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তারা রাষ্ট্রের জ্ঞানী-গুণী মানুষ, তবে রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতা তাদের নেই। গত তিন মাসে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আমার চোখে পড়েনি। সংস্কার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, সেটা রাজনৈতিক দল ছাড়া করা প্রায় অসম্ভব। এখন নির্বাচন করতে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটুকু করে নির্বাচন দিয়ে দেওয়াই উত্তম। দেশে সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়ে গেছে পতিত স্বৈরচার। সেই সব সংস্কার করতে কমছে কম ১০ বছর সময় লাগবে। আমরা চাইব দ্রুত নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের হাতে বাকি সংস্কারের দায়িত্ব অর্পণ করবেন তারা। বর্তমান সরকার একটি দুর্বল সরকার, যার কারণে পতিত স্বৈরচার ভারতে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করে তারা আবার দেশে ফিরে আসতে চায়। যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত বলে আমি মনে করে। জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগেই দিয়ে রেখেছেন, আমারা সকাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করব। এখন জাতীয় সরকার গঠন করলে সংকট আরও বাড়বে। পালিয়ে যাওয়া সরকারের আবার ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ রূপালী বাংলাদেশেকে বলেন, ‘আমরা জাতীয় ঐক্য নিয়ে কাজ করছি। এই মুহূর্তে জাতীয় সরকার নিয়ে দলের কোনো পর্যবেক্ষণ আমার জানা নেই। তবে আমরা চাই দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তি।’
বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সরকারের ধারণাটি আসে ১৯৭১ সালে। সে সময় আওয়ামী লীগের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের দাবি ছিল সব দলকে নিয়েই সরকার গঠন করা হোক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সেই দাবি মেনে নেয়নি, তারা এককভাবে সরকার গঠন করে। স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের প্রথম দাবি উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
আওয়ামী লীগ সেই দাবি গ্রাহ্য করেনি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে আবার জাতীয় সরকারের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। জাতীয় সরকার নাকি নির্বাচন কোনটা হবে আগে, তা বলে দেবে সময়।
আপনার মতামত লিখুন :