প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় ২০২২ ও ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ১৫টি প্রেসকে ‘কালো তালিকা’ভুক্ত করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এনসিটিবির স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এসব প্রেসকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৫টির মধ্যে অধিকাংশ প্রেসের কালো তালিকায় থাকার নির্দিষ্ট সময় ছিল পাঁচ বছর। আর অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় দুই-তিনটি প্রেসকে স্থায়ীভাবে কালো তালিকায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কালো তালিকায় থাকা প্রেসগুলো মেয়াদ শেষের আগে এনসিটিবির পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ করতে পারবে না। আর তালিকায় স্থায়ীভাবে থাকা প্রেসগুলো আজীবনের জন্য এনসিটিবির বই মুদ্রণের কাজ করার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এনসিটিবির শীর্ষপদেও রদবদল হয়। রদবদলের মাস দুয়েক আগে প্রেসগুলোকে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কালো তালিকা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দায়মুক্ত করা হয়। এনসিটিবির বোর্ড সভার সুপারিশ অনুযায়ী প্রেসগুলোকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সুপারিশ ছাড়া অব্যাহতির ঘটনায় পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি অপরাধের গুরুত্বসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা ছাড়াই আবেদন করা সব প্রেসকে অব্যাহতি দেওয়ার নেপথ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্টতার বিষয় নিয়েও অভিযোগ রয়েছে এনসিটিবির কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে। এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান এ বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার যেমন কারণ থাকে, তেমনি সেখান থেকে অব্যাহতির কারণ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখানে কী কারণে এমন হয়েছে তা জানা নেই। এ ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তি ও অব্যাহতি উভয় ক্ষেত্রে সচেষ্ট থেকে কাজ করতে হবে।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কোনো ভ্যালিড (বৈধ) কারণ ছাড়া এটি (অব্যাহতি) করা সঙ্গত নয়। এ ক্ষেত্রে পূর্বাপর বিষগুলো বিবেচনায় নিয়ে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বইয়ের কাজ করা হবে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে বইয়ের গুণগতমান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা বজায় রাখা ও সরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যাপকভাবে সক্রিয় করা।
এদিকে প্রেসগুলোকে অব্যাহতি দেওয়ার সময় এনসিটিবির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে তিনি জানিয়েছেন, প্রেসগুলোর আবেদনের ভিত্তিতে বোর্ড সভায় কালো তালিকা থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বোর্ড সভায় উপস্থিত সবাই এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। আগামী শিক্ষাবর্ষের বই উৎপাদন ও বিতরণে যেন কোনো সিন্ডিকেট গড়ে না ওঠে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানা গেছে, প্রতিবছর বিনা মূল্যের পাঠ্যবই উৎপাদন ও বিতরণ কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বই মুদ্রণের কাজে জড়িত প্রেসগুলোর সরবরাহ করা বইয়ের মান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী হচ্ছে কি না তা নজরে রাখা হয়। এনসিটিবির নিজস্ব মনিটরিং টিম ও নিয়োগ করা ইন্সপেকশন এজেন্ট প্রেসগুলোর বই ছাপানোর কাগজ, ছাপানো বই ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করেছে কি না অথবা জরিমানা দেওয়ার পরও বই দিতে পেরেছে কি না ইত্যাদি বিষয় নজরদারি করে কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত ‘মনিটরিং রিপোর্ট’ দেয়।
এছাড়া বই ছাপানোর জন্য প্রেসগুলোর ব্যবহৃত কাগজ মানসম্পন্ন কি না তা জানার জন্য ব্যাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) অথবা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়। বই উৎপাদন ও বিতরণ কাজ শেষ হওয়ার পর মনিটরিং রিপোর্টসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এনসিটিবির স্থায়ী উৎপাদন কমিটি সভা করে। সভায় বই উৎপাদন ও বিতরণে যেসব প্রেস পিপিআরের শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়, তাদের কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে অনুমোদনের জন্য এনসিটিবির বোর্ড সভায় পাঠানো হয়। পরে এনসিটিবির বোর্ড সভায় স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সুপারিশ যাচাই-বাছাই করে কালো তালিকার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সাবেক এক সদস্য জানিয়েছেন, ছয় সদস্যের কমিটিতে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) আহ্বায়ক ও বিতরণ নিয়ন্ত্রক সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া এনসিটিবি সচিব ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রকসহ আরো দুজন কমিটির সদস্য ছিলেন। স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সদস্যসংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। তবে এনসিটিবির বোর্ড সভা হয় চেয়ারম্যান ও চার সদস্য যথাক্রমে সদস্য (পাঠ্যপুস্তক), সদস্য (কারিকুলাম), সদস্য (প্রাইমারি) ও সদস্যকে (অর্থ) নিয়ে। সভায় এনসিটিবি সচিব শুধু সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসগুলোকে অব্যাহতি দেওয়ার সময় এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান (কারিকুলাম), প্রফেসর মো. মোখলেস-উর-রহমান (প্রাইমারি) এবং যুগ্ম সচিব মো. মুনির হোসেন খান (অর্থ)। এ সময় সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) পদটি শূন্য থাকায় সদস্য (অর্থ) মো. মুনির হোসেন খান সদস্য (পাঠ্যপুস্তক)-এর অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন।
এনসিটিবি ও সে সময়ের স্থায়ী উৎপাদন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ ও ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বাজে কাগজে বিনা মূল্যের বই উৎপাদন ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে জরিমানা দিয়েও নির্দিষ্ট সময়ে বই সরবরাহ করতে না পারার অভিযোগে স্থায়ী উৎপাদন কমিটি সভা করে ১৫টি প্রেসকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করে। এসব প্রেসের মধ্যে রয়েছে ‘র’, ‘ট’ ‘ন’ ‘অ’ ‘স’ ‘ম’ ‘ম’ ‘ম’ ‘ম’ ‘আ’ আদ্যাক্ষরযুক্ত প্রেস।
‘হ’ আদ্যাক্ষরযুক্ত একটি প্রেসকে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্তের সুপারিশ করা হলেও অদৃশ্য কারণে তার নাম বাদ রাখা হয়। এই প্রেসগুলোর মধ্যে দুই-তিনটি প্রেসকে আজীবনের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, পরবর্তী সময়ে নিয়ম অনুযায়ী প্রেসগুলো কালো তালিকা থেকে অব্যাহতির জন্য আলাদাভাবে এনসিটিবি বরাবর আবেদন করে। কমিটির আহ্বায়ক সদস্য (অর্থ) যিনি একাধারে সদস্য (পাঠ্যপুস্তক)-এর দায়িত্ব পালন করছিলেন, তার নেতৃত্বে স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সভায় সাতটি প্রেসের অব্যাহতির আবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় কমিটির আহ্বায়ক বিষয়টি এনসিটিবির বোর্ড সভায় উপস্থাপন করার পরামর্শ দেন।
পরবর্তী সময়ে আগের সাতটির সঙ্গে বাকি প্রেসগুলোর অব্যাহতির আবেদন আমলে নিয়ে এনসিটিবির বোর্ড সভায় প্রথমে চারটি, দ্বিতীয়বার তিনটি ও তৃতীয়বার বাকি প্রেসগুলোকে কালো তালিকা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এই স্থায়ী উৎপাদন কমিটি সূত্র ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ‘হ’ আদ্যাক্ষরযুক্ত একটি প্রেসকে সভায় কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হলেও তা না হয়ে এই প্রতিষ্ঠানেরই কালো তালিকায় থাকা আরেকটি প্রেসকে অব্যাহতি দিয়ে দায়মুক্ত করা হয়।
সূত্রের দাবি, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এনসিটিবি বোর্ড সভার মাধ্যমে প্রেসগুলোকে অব্যাহতি দিয়ে দায়মুক্ত করতে পারে। তাতে আইনের কোনো ব্যত্যয় না হলেও যে কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে প্রেসগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়, তাদের সুপারিশ ছাড়া অব্যাহতি নীতিগতভাবে পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বই উৎপাদন ও বিতরণে জড়িত সূত্রগুলো জানিয়েছে, যে প্রেসগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তারা সব সময়ই বই নিয়ে অনিয়ম করে। এসব প্রেসের আওতায় অন্য নামে একাধিক প্রেস থাকে।
একটা প্রেসকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলে অন্য নামে আরেকটি প্রেস কাজ করে। তাই তাদের অনিয়ম ঠেকানো মুশকিল। শাস্তির নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষের আগে বিশেষ করে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় থাকা প্রেসগুলোকে অব্যাহতি দেওয়ায় প্রেসগুলো আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজেও যে অনিয়ম করবে না, তা কোনোভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সূত্র।
আপনার মতামত লিখুন :