ঢাকা শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

বছরে খরচ বাড়বে ৬ হাজার কোটি টাকা

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪, ১২:৫২ এএম

বছরে খরচ বাড়বে ৬ হাজার কোটি টাকা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী পাঁচ বছরে (২০২৫-২০৩০) জলবায়ু সংক্রামক রোগে বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা খাতে আনুমানিক অতিরিক্ত খরচ বাড়বে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ ৮১৭ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলার ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৩৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার অপুষ্টিজনিত রোগের চিকিৎসায় অতিরিক্ত খরচ হবে। এর পরে যথাক্রমে আঘাত ও পানিতে ডোবার জন্য ৪০২ দশমিক ৯৪, ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের জন্য ৩১৬ দশমিক ১৭, পতঙ্গবাহিত রোগ যেমন-ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকনগুনিয়ার জন্য ৩০৮ দশমিক ৮২ ও অন্যান্য (মানসিক) রোগের চিকিৎসায় ২২০ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্য খাতের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য প্রস্তুত করা জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযোজন বা সুরক্ষা (এইচএনএপি) পরিকল্পনার চূড়ান্ত কর্মকৌশল থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। কর্মকৌশলে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে।

সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি সব আলোচনায় জলবায়ু সংক্রামক রোগকে গুরুত্ব  দেওয়া।

স্বাস্থ্য অভিযোজন (সুরক্ষা) খাতে বাজেট বাড়ানো। স্বাস্থ্য খাতের সেক্টর প্রোগ্রামগুলো, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য অভিযোজন প্রোগ্রামের স্বতন্ত্র বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তৈরি করা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিটকে (সিসিএইচপিইউ) রাজস্ব বাজেটের আওতায় আলাদা ইউনিট হিসেবে কার্যকরা করা। গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর লক্ষ্যে সারা দেশের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রিন হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভ প্রতিষ্ঠা করা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিটের (সিসিএইচপিইউ) সমন্বয়কারী ও এইচএনএপি কর্মকৌশল প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীর।

প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসে এইচএনএপি বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে চিকিৎসা খাতে দেশের মানুষের ব্যয়ের বোঝা কমানো সম্ভব হবে। এর ফলে আর্থিক খাতে দেশের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। ২০২৫ সালের জুলাই থেকে এইচএনএপি বাস্তবায়নের আশা প্রকাশ করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ-গবেষক।

কর্মকৌশলে উপস্থাপিত তথ্য থেকে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রিকসংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৫১ শতাংশ মানুষের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে নিউমোনিয়ায় ১৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এরপর যথাক্রমে রয়েছে দুশ্চিন্তা ও মানসিক রোগ ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ, মূত্রনালির সংক্রমণ ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, টাইফয়েড জ¦র ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ, কলেরা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ও ডায়বেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে ২ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষের।

এদিকে নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শীতজনিত নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে এক লাখের বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আইসিডিডিআরবির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচটি সংক্রামক রোগের মধ্যে নিউমোনিয়া একটি। সংক্রামক রোগে শূন্য দশমিক ৭ মিলিয়ন মৃত্যুর ১৪ শতাংশ নিউমোনিয়ায়। বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। প্রতিবছর মারা যায় কমপক্ষে ২৪ হাজার ৩০০ জন শিশু। শিশুদের ৫২ শতাংশই মারা যাচ্ছে বাড়িতে এবং কোনো ধরনের চিকিৎসা না পেয়েই।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সি ৮০ হাজারের মতো শিশু ভাইরাল নিউমোনিয়ায় ও বিভিন্ন ধরনের রেসপিরেটরি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সিদের শতকরা ২৮ ভাগের মৃত্যুর কারণ এই নিউমোনিয়া।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ নভেম্বর থেকে গত ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত (এআরআই বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ) সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা, ব্রংকাইটিস, ব্রংকিওলাইটিস ও নিউমোনিয়ায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৩৬ হাজার ৭২২ জন। সারা দেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৯৪ হাজার ৩৬১ জন।

জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযোজন বা সুরক্ষা (এইচএনএপি) পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এইচএনএপি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে এ ধরনের অকালমৃত্যু অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব।

সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বিস্তৃত জলবায়ু পরিবর্তন এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা-স্বাস্থ্য যাচাইকরণ কর্মশালা (সি৩এইচএনপিএ)’-এর মাধ্যমে খসড়া জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযোজন বা সুরক্ষা (এইচএনএপি) পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।

অনুষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও এমিরেটাস প্রফেসর আইনুন নিশাত বলেন, এইচএনএপি শিগগিরই চূড়ান্ত হবে। যদি আরো কিছু যুক্ত করার মতো প্রয়োজনীয় বিষয় থাকে, পরবর্তী সময়ে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিটের- সিসিএইচপিইউ সমন্বয়কারী ও রোগতত্ত্ববিদ প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীরের নেতৃত্বে এই পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসে এই সুরক্ষা পরিকল্পনা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল এডাপশন প্ল্যান (এনএপি) বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’-এ অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। সিসিএইচপিইউ এই কর্মশালার আয়োজন করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ ও এফসিডিও ইউকে কর্মশালায় কারিগরি সহায়তা দেয়। 
জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলা করে সহনশীল উন্নয়ন প্রচারের লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘ন্যাশনাল এডাপশন প্ল্যান (এনএপি) বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করে জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাসের চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীর জানান, কর্মশালায় এ বিষয়ে যেসব সুপারিশ উঠে এসেছে, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে জানুয়ারির মধ্যে সম্পূর্ণ চূড়ান্ত করা হবে। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে প্রথম ২০১৮ সালে এইচএনএপি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হলেও সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সাল থেকে দুই বছর কাজ করার পর বর্তমানে এইচএনএপি বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা (অভিযোজন) পরিকল্পনা বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীর। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সাইদুর রহমান। সম্মানিত অতিথির বক্তৃতা করেন এমিরেটাস প্রফেসর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত। ইউএনএফপিএর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ভিভেন্দ্র রংঘুবংশী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. মো. আবু জাফর অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতি হিসেবে সুপারিশ পেশ করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ টি এম সাইফুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমীদ আহমেদ, ব্রিটিশ হাইকমিশনের রাশীদ জামান ও বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ডা. বিভাবেন্দ্র রঘুবংশী প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া সিভিল সোসাইটি ও দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নিয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

প্রাথমিকভাবে চারটি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যায়। প্রথমত এর ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে যায়। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায় এবং আবহাওয়া চরম হয়ে ওঠে, যেমন- গরমের সময় প্রচণ্ড গরম ও শীতের সময় প্রচণ্ড শীত অনুভূত হয়।

এই চার প্রভাবের কারণে প্রকৃতিতে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সেগুলো হলো- আবহাওয়ার তীব্রতা বেড়ে যায়। বাতাস দূষিত হয়। অতিরিক্ত উত্তাপ ছড়ায়। পরিবেশগত অবনতি হয়। খাদ্য ও পানি সরবরাহে প্রভাব পড়ে। পানির গুণগত মান নষ্ট হয়। এলার্জি বৃদ্ধি পায় ও ভেক্টর (পতঙ্গ) ইকোলজিতে পরিবর্তন হয়।

অতিরিক্ত তাপের কারণে কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ে। পরিবেশ অবনতি হওয়ায় জোরপূর্বক অভিবাসন ও নাগরিক সংঘাতে সৃষ্ট অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। দূষিত বায়ুর কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ সৃষ্টি হয়। ভেক্টর ইকোলজির পরিবর্তনে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, হান্টা ভাইরাস, এনসেফালাইটিস, চিকনগুনিয়া ও ওয়েস্টনাইল ভাইরাসে আক্রান্তের শঙ্কা তৈরি হয়। এলার্জি বাড়ায়, রেসপিরেটরি এলার্জি ও অ্যাজমা বাড়ে। খাদ্য ও পানি সরবরাহের প্রভাব পড়ায় অপুষ্টি, ডায়রিয়া ও কলেরা রোগের সৃষ্টি হয়।

আরবি/জেডআর

Link copied!