সিসিটিভির ফুটেজে টাকা চুরির দৃশ্য ধরা পড়ে আলোচনার জন্ম দেওয়া যশোরের চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালামের দখল-চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। ৫ আগস্টের পর মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়সহ বিল-বাঁওড়-বাজারে দখল-চাঁদাবাজি, দলীয় ও কলেজের কমিটি বাণিজ্য, সালিশ মীমাংসার নামে টাকা আত্মসাৎ এবং আর্থিক সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগের এজেন্টদের পুনর্বাসনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
উপজেলার নিরীহ মানুষের কাছে বিএনপির এই নেতা আতঙ্কের নাম। চাহিদামতো চাঁদা না দিলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাদের দলীয় পদে বসাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে টাকা চুরির ভিডিও, চৌগাছা উপজেলা কমিটির পদবাণিজ্যর বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে যশোর জেলা ও কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছে।
নিপীড়িতরা অভিযোগে বলেছেন, উপজেলাজুড়ে সালামের দখল-চাঁদাবাজির ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও নীরব জেলা ও কেন্দ্রীয় বিএনপি। এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা। বিএনপির মতো একটি আদর্শিক রাজনৈতিক দলের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাঁদাবাজ ও দখলদার কীকভাবে রয়েছেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন চৌগাছার সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এম এ সালামের বিরুদ্ধে চৌগাছার সাতটি বিল-বাঁওড় দখলসহ অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে চাঁদাবাজি ও আওয়ামীপন্থি নেতাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। সলুয়া আদর্শ ডিগ্রি কলেজে কমিটি দেওয়ার লিখিত নোটিশ পাঠিয়েছেন থানা সভাপতি সালাম। নতুন কমিটি করতে চাপ সৃষ্টির জন্য চিঠি দিয়েছেন। উপজেলার বিল-বাঁওড়ে প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হয়েছে মাছ চাষের জন্য। তাদের কাছ থেকে গত তিন মাস ধরে চাঁদা তোলা হচ্ছে।
বেড়গবিন্দ্রপুর বাঁওড় সরকারিভাবে ইজারা নিয়েছেন মো. কাশেম (ব্যবসায়ী)। তথ্য পাওয়া গেছে, ৭ সেপ্টেম্বর চৌগাছার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সালাম বেড়গবিন্দ্রপুর বাঁওড়টির মাছ লুট হবে না এবং তাকে সুষ্ঠুভাবে মাছ চাষ ও মাছ ধরতে দেওয়া হবে এই শর্তে অনৈতিকভাবে ২ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। ইজারাদারকে ৩৫ শতাংশ মাছ আহরণের নিশ্চয়তা দেন। তবে সভাপতির প্রত্যক্ষ মদদে যুবদলের আহ্বায়ক মো. সালাউদ্দীন সেখানে মাছ লুট ও বাঁওড় লাগোয়া ১৫ বিঘার দুটি সরকারি পুকুর দখলে নিয়েছে। বল্লভপুর বাঁওড় বল্লভপুর গ্রামের সনাতন সমিতির আওতায় ইজারা রয়েছে। গত ৭ আগস্ট থেকেই মাছ লুটের ঘটনা ঘটছে, যা গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাপকভাবে সভাপতির লোকজন সেখান থেকে অর্ধকোটি টাকার মাাছ লুট করে। চাঁদা না দেওয়ায় এখনো মাছ লুট করা হচ্ছে বলে সনাতন সমিতির অভিযোগ। কাকুড়িয়া বাঁওড় কাকুড়িয়া মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি শ্রী সন্তোষ হালদারের আওতায় ইজারা রয়েছে, যেখানে চৌগাছা বিএনপির সভাপতি তার নিজের লোকজন দিয়ে ২৫ ভাগ মাছের চুক্তি ও চাঁদা দাবি করলে তারা অপত্তি জানান। পরে সালামের অনুসারী আমিনুর খাঁ, মামুন, হানেফসহ বাঁওড়ের ইজারাদার সন্তোষ এবং বাঁওড়ের দায়িত্বে থাকা আরও দুজনকে মারধর করে। মারধর ও চাঁদাবাজির ঘটনায় সন্তোষ হালদার যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেন। যদিও তার কোনো সমাধান হয়নি। লক্ষ্মীপুর বাঁওড়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ২৫ শতাংশ চাঁদার বিষয়ে চুক্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। চাকলা (সরুপপুর) বাঁওড় চৌগাছার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সরাসরি আদেশে লুট এবং তাদের লোকজন দেলায়ার মেম্বারের দখলে দেওয়া হয়েছে।
ইজারাদার কার্যত অসহায় অবস্থায় আছেন। চাকলা বিল মো. শামিমের আওতায় ইজারা রয়েছে। তবে সালামের মাধ্যমে তার অনুসারী করিম ও মইনুলকে দেওয়া হয়। এ নিয়ে দলীয় কোন্দলের কারণে অন্য গ্রুপ শান্ত মেম্বারের দখলে দেওয়া হয়। খড়িঞ্চা বাঁওড় সনাতন সমিতির শ্রী উত্তম কুমারের আওতায় ইজারা রয়েছে। সেখানেও বিএনপির নেতা সালাম চাঁদা দাবি এবং আওতায় নেওয়ায় জন্য নানা চাপ প্রদান করে আসছেন। এর প্রতিকার পেতে উত্তম কুমার যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া সভাপতি সালাম একটি পরিবারের প্রায় ৭০ বছর ধরে চলে আসা পারিবারিক ব্যবসা ‘জি. এস হোমিও হল’ প্রতিষ্ঠান জোর করে দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী আজাদুর রহমান এর সমাধান পেতে কেন্দ্রীয় বিএনপি বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন।
চৌগাছা উপজেলা ভবনের পাশের স্থানীয় চাওল ব্যবসায়ী মো. লিটনের আড়ত থেকে বিএনপির সভাপতি সালামের বডিগার্ড মইফুল ৮৬ হাজার টাকা জোরপূর্বক চাঁদা নিয়েছেন।
ভুক্তোভোগী লিটন জানান, সালামের সরাসরি মদদে তার বডিগার্ড মইফুল এক নারীকে দিয়ে আমাকে জিম্মি করে ৬ লাখ টাকা দাবি করেন এবং ৮৬ হাজার টাকা নিয়ে সেটি সুরাহা করে। তিনি জানান, এই টাকার বিষয়ে সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এখন টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় সার ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের কর্মী লেন্টুর (সার লেন্টু) নিজের পারিবাপরিক-ব্যাবসায়িক কয়েক কোটি টাকা নিজের শরিকের ভাগ ফাঁকি এবং পারিবারিক সম্পত্তি থেকে আপন চাচাকে বঞ্চিত করতে সভাপতি সালাম ও সাধারণ সম্পাদক ৫ লাখ টাকা (চেক) চাঁদা নিয়েছেন বলে অভিযোগ দিয়েছেন লেন্টুর ছোট চাচা। বিএনপির সভাপতি সালামের সরাসরি মদদে তার আপন ছোট ভাই চৌগাছা উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক এম এ মান্নানসহ মইফুল ইসলাম সেলিম একযোগে চৌগাছা ইউনিয়নের মনমথপুর গ্রামের আইজুদ্দীনকে ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা আদায় করেছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া স্থানীয় বলুহর মেলা কমিটি থেকে জানানো হয়, মেলা থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা চাঁদা দেওয়া হয়েছে বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে।
বাঁওড় লুট ও চৌগাছার পরিস্থিতি বিষয়ে যশোরের চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুস্মিতা সাহা জানান, বল্লভপুর বাঁওড়ে মাছ লুটের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি, সেখানে মারামারির ঘটনাও ঘটেছিল। যাদের নামে অভিযোগ এসেছিল, আমরা নাম পুলিশে দিয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে ভালো আছে। দল-মত নয়, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, আমরা চেষ্টা করছি আইনিভাবে ব্যবস্থা নিতে।
চৌগাছা বিএনপির একাধিক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, উপজেলা সভাপতি ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বড় অঙ্কের টাকা আদায় করছেন, তবে ভয়ে যারা দিচ্ছেন তারাসহ যারা জানেন তারাও মুখ খুলছেন না।
চৌগাছার একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় রাজনৈতিক খুনাখুনি ছিল না, তবে মাত্র কদিনে দুটি খুন হয়েছে দলাদলিতে, এটা আমরা আশা করি না। আমরা চাই রজনীতি হবে মানুষের মঙ্গলে। তবে তা হচ্ছে না। ’৭১-এর পর থেকে দেখছি, যারা রাজনীতি করতেন, তারা যে দলেরই হোক, নিজ এলাকার সবাই সবার ভাই ভাই। এখন দেখি নিজ দলের মধ্যে কামড়াকামড়ি। ভেবেছিলাম দেশ নতুনভাবে স্বাধীন হলো। এখন দেখি কিছু মানুষ আগের থেকে বেশি নির্যাতন শুরু করছে। যারা এলাকার চিহ্নিত চোর-বাটপাড়, তারাই এখন নেতা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সভাপতি এম এ সালামকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার পারিবারিক সম্মান-ঐতিহ্য রয়েছে। আমি কোনো ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই। আমার উপজেলায় কোনো বাঁওড়ে কোনো ধরনের মাছ লুট হয়নি। কারও কাছ থেকে আমি বা আমার ছোট ভাই কিংবা আমার কোনো লোক টাকা গ্রহণ করেনি। আমি সাধারণ মানুষ। মানুষের টাকাপয়সা বা চাঁদাবাজি, দখল এগুলোর সঙ্গে আমি জড়িত নই।’ চৌগাছার মানুষ এখন খুবই শান্তিতে আছে বলেও দাবি করেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, বাঁওড় দখল বা চাঁদাবাজির বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। যদি এমন অভিযোগ আসে, সে ক্ষেত্রে আমরা যাচাইবাছাই করে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
আপনার মতামত লিখুন :