টেলিকম-সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ও বিভিন্ন সেবাসুবিধা টেলিকম অপারেটরদের মাঝে বিনিময়সংক্রান্ত বিদ্যমান ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’-এ পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এরই মধ্যে পরিবর্তিত গাইডলাইনের একটি খসড়া করা হয়েছে। এতে কিছু বিষয়ে পাল্টাপাল্টি আপত্তি রয়েছে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন্স ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) অপারেটর ও মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (এমএনও)। খসড়া গাইডলাইন বাস্তবায়িত হলে ব্যবসা হারানোর আশঙ্কা এনটিটিএনদের।
অন্যদিকে পরিবর্তিত গাইডলাইনেও এনটিটিএনদের সঙ্গে সহাবস্থান সম্ভব বলে মত এমএনওদের। ফলে গাইডলাইনের খসড়ায় একপ্রকার মুখোমুখি অবস্থানে পৌঁছেছে এনটিটিএন এবং এমএমও প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে গ্রাহকদের বৃহত্তর স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই গাইডলাইন চূড়ান্ত করার কথা জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় বিটিআরসি। তখন থেকেই খসড়ার কিছু বিষয়ে আপত্তি জানাতে থাকে এনটিটিএন অপারেটরগুলো; বিশেষ করে ‘অ্যাকটিভ শেয়ারিং’সংক্রান্ত কয়েকটি নীতিমালা নিয়ে। বিদ্যমান নীতিমালা ও প্রস্তাবিত খসড়ায় অ্যাকটিভ শেয়ারিংয়ের মূল অর্থ একই। বেস ট্রান্সফার স্টেশন (বিটিএস) বা নেটওয়ার্ক টাওয়ার, স্পেকট্রাম, ফিডার কেবল, সিগন্যাল ট্রান্সফার পয়েন্ট, অপটিক্যাল ফাইবার ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের মূল চালিকাশক্তির মতো অন্যান্য বৈদ্যুতিকভাবে যুক্ত অবকাঠামোর বিনিময়কে অ্যাকটিভ শেয়ারিং বলা হয়। এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, এমএনওদের অ্যাকটিভ শেয়ারিংয়ের অনুমতি দিলে, সেটি হবে এনটিটিএন গাইডলাইনের সাথে সাংঘর্ষিক। নতুন গাইডলাইনে অপটিক্যাল ফাইবার লে-আউট বসাতে পারবে এমএনওগুলো। পাশাপাশি বিনিময়ও করতে পারবে টেলিকম অপারেটরদের সাথে। আবার এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম সেবা এই অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন। এই সেবা টেলিকম অপারেটরগুলো দেওয়া শুরু করলে বাজার হারাবে বলে দাবি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর। অপটিক্যাল ফাইবারসহ অ্যাকটিভ শেয়ারিংয়ের সংজ্ঞায় উল্লেখিত প্রায় সব অবকাঠামো ও সেবা এনটিটিএনগুলো দিয়ে থাকে। এগুলোর বাজার হারালে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে দাবি এনটিটিএন অপারেটরদের।
বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতের তিনটি করে মোট ছয়টি এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো বাংলাদেশ রেলওয়ে, পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ কোম্পানি (পিজিসিবি), বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), ফাইবার অ্যাট হোম, সামিট কমিউনিকেশন্স এবং বাহন লিমিটেড। নতুন গাইডলাইনের খসড়া নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু বলা হয়নি। তবে বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটরগুলোর আপত্তি রয়েছে প্রস্তাবিত খসড়া গাইডলাইনের ৭.৩ অনুচ্ছেদ নিয়েও।
এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, টেলিকম অপারেটর ছাড়া অন্য কারও থেকে ট্রান্সমিশন রিসোর্স কিনতে পারবে না এনটিটিএন। টেলিকম অপারেটর হিসেবে কার্যত মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের থেকেই ট্রান্সমিশন রিসোর্স কেনার বাধ্যবাধকতা চাইছে না এনটিটিএনগুলো।
ফাইবার অ্যাট হোমের চিফ গভর্নমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার আব্বাস ফারুক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও টেলি যোগাযোগব্যবস্থা পৌঁছে দিতে এনটিটিএন অপারেটরগুলোর অবদান রয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশের আনাচে-কানাচে অপটিক্যাল ফাইবার পৌঁছে দিয়েছি আমরা। এনটিটিএন গাইডলাইনে অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর এক্তিয়ার শুধু এনটিটিএন অপারেটরদের দেওয়া হয়েছে। এই আইনি সুরক্ষার কারণেই এনটিটিএন অপারেটরগুলো বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে কাজ করছে এবং বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তাছাড়া এনটিটিএনের জন্মই হয়েছিল অ্যাকটিভ শেয়ারিংয়ের জন্য। এখন যদি আইনের সেই সুরক্ষাবলয় সরিয়ে নেওয়া হয়, যদি সবাই ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ার করতে পারে, তাহলে এনটিটিএনগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। দেখা যাবে, আমাদের অ্যাক্টিভ ইনফ্রাস্ট্রাকচার একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দিচ্ছে। গাইডলাইনে যাই বলা থাকুক না কেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বাস্তবে কে কী করছে তা তদারক করা একপ্রকার অসম্ভব। এমনটা এনটিটিএন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে মোবাইল অপারেটরগুলো বলছে, ‘লাস্ট মাইল এন্ড’ অর্থাৎ নেটয়ার্ক ট্রান্সমিশনের শেষ ধাপ বা সেবা প্রদানকারী এবং ব্যবহারকারীর স্তরে এখনো এনটিটিএন কাভারেজ নেই। অনেক সময়েই প্রত্যাশিত মুনাফার নিশ্চয়তা না থাকায় এনটিটিএনরা সেখানে ফাইবার অপটিক বিস্তারে বিনিয়োগ করে না বলেও অভিযোগ অপারেটরদের। এমন প্রেক্ষাপটে নিজেদের গ্রাহকদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে নিজেরাই ফাইবার বসানোর সুযোগ চায় এমএনও।
দেশের বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ বলেন, ‘অপারেটরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রাহক ও অপারেটর উভয়ের জন্য সুবিধাজনক অবকাঠামো শেয়ারিং নীতিকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে গ্রামীণফোন। তবে এই উদ্যোগ নির্দিষ্ট কোনো অপারেটর বা অপারেটরদের জন্য নয়, বরং টেলিযোগাযোগ শিল্পের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে হওয়া উচিত। যেকোনো ধরনের শেয়ারিং হওয়া উচিত স্বেচ্ছামূলক, বাজারনির্ভর ও পক্ষপাতহীন। উদ্ভাবন ও সহযোগিতাকে উৎসাহিত করতে শেয়ারিংয়ের বিভিন্ন মডেল বা পার্টনারশিপ মডেল অনুমোদনের বিষয়টি কমিশন বিবেচনা করতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জনগণের কল্যাণ বয়ে আনবে।’
রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই টেলিযোগাযোগ খাতে অবকাঠামো ভাগাভাগির বিষয়টি নিয়ে খাতসংশ্লিষ্ট সব পক্ষই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে উদ্যোগ গ্রহণে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় যে খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে, সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আশা করব, কোনো লাইসেন্সির স্বার্থের চেয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে।’
যদিও ‘লাস্ট মাইল এন্ড’ ধারণার সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে এনটিটিএনদের। বাহন লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার রাশেদ আমিন বিদ্যুৎ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মতো মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে ‘লাস্ট মাইল এন্ড’ ধারণা সঠিক নয়। এমএনওদের সঙ্গে ব্যবহারকারীরা যুক্ত থাকেন টাওয়ারের মাধ্যমে, অর্থাৎ তারহীন প্রযুক্তিতে। সেখানে লাস্ট মাইল এন্ডের ধারণাই ভুল। এমএনওগুলো এই অজুহাতে সব বিটিএস নিজেদের ফাইবার অপটিকে যুক্ত করতে পারে। তাহলে এনটিটিএনের আর কিছু থাকে না। বিটিআরসি ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং নিয়ে কী করছে, সে বিষয়টিও অস্পষ্ট। যে যা পারছে বিটিআরসিকে বোঝাচ্ছে।
বিটিআরসিও সব ধরনের লাইসেন্স গ্রহীতাকে ‘হোপ’ দিচ্ছে। এমএনও যখন কথা বলছে, তাদের আশ্বাস দিচ্ছে। আবার এনটিটিএনরা যখন যোগাযোগ করছে, তাদেরও বলছে ‘সব ঠিক আছে’। বিটিআরসির ভূমিকাও পরিষ্কার নয়।
অবশ্য সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই গ্রাহকদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে বিটিআরসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্দিষ্ট একটি খাত হিসেবে নয়, বরং সামগ্রিকভাবে দেখছি। একজন গ্রাহকের কাছে যখন সেবা পৌঁছায়, গ্রাহক তো জানে না যে কোন কোন নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে তার কাছে কনটেন্টটা এলো। আয় আসছে গ্রাহকদের থেকে। গ্রাহক পুরো নেটওয়ার্কের জন্য অর্থ দিচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এটা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব যে, গ্রাহকদের খরচকে যৌক্তিক করা। এ জন্য নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশন কার সাথে কীভাবে হবে, সে বিষয়টি মূল্যায়ন করছি। আর এই মূল্যায়ন ‘আইসোলেশনে’ (অংশীজনদের সম্পৃক্ততাবিহীন) হবে না। কেনো এক পক্ষের কথা শুনে (গাইডলাইন) করে ফেলব, তা না। সবার কথা শুনেই করব। ইন্ডাস্ট্রির সবার সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া চলছে।
আপনার মতামত লিখুন :